ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Sharenews24

রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে ফিলিস্তিনের কী লাভ? 

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ ১৫:০০:৪৪
রাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে ফিলিস্তিনের কী লাভ? 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে সম্প্রতি একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগালসহ পশ্চিমা বিশ্বের বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ দেশ ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশ জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস মূলত একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র গঠনের পথ দীর্ঘদিন রুদ্ধ ছিল। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর সামরিক শাসন, বসতি স্থাপন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দখলদার ইসরায়েলের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৬৯ সালে তখনকার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার এক বিতর্কিত বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি বলেন, "এই এলাকায় ফিলিস্তিনিদের নামে কিছুই নেই।" এর পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রত্বের ধারণাকে সংগঠিত করার জন্য কাজ শুরু করে। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা লিখেছিলেন প্রসিদ্ধ কবি মাহমুদ দারবিশ এবং এটি প্রদান করেছিলেন পিএলও-এর নির্বাসিত নেতা ইয়াসির আরাফাত।

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অবস্থান ছিল মিশ্র। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরবসহ বহু দেশ ফিলিস্তিনকে সমর্থন ও স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইয়াসির আরাফাতকে জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়ার অনুমতিও দেয়নি, যার ফলে জেনেভায় জাতিসংঘের বৈঠক স্থানান্তর করতে হয়।

নব্বই দশকে অসলো চুক্তি একটি আশার আলো জাগিয়েছিল, তবে তা সীমাবদ্ধ থেকে যায় অস্থায়ী স্বশাসিত প্রশাসনের মধ্যেই, যেখানে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন সীমান্ত বা স্থায়ী রাজধানী ছিল না। এরপরের দশকগুলোতে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে ইসরায়েলি দখল আরও সুসংহত হয়েছে।

বর্তমানে ফিলিস্তিন একটি আধা রাষ্ট্র বা কোয়াজি স্টেট হিসেবে বিবেচিত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের উপস্থিতি রয়েছে, কূটনৈতিক মিশন রয়েছে এবং তারা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে। ২০১২ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন স্থায়ী পর্যবেক্ষক মর্যাদা পায়। তবে পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলের কার্যত নিয়ন্ত্রণ এবং দখলের বাস্তবতা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পূর্ণতা দিতে পারেনি।

বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি বাস্তবে খুব বড় কিছু পরিবর্তন আনবে না। তবে এটি সম্পূর্ণ অবহেলা করা যাবে না, কারণ এই স্বীকৃতি ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কাঠামোর অংশ করে তোলে। এর ফলে ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারবে, যুদ্ধবিরতির পক্ষে আরও শক্তিশালী দাবি তুলতে পারবে এবং তাদের রাষ্ট্রীয় অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনায় ইসরায়েল ও তার মিত্রদের একতরফা সিদ্ধান্ত চাপানো কঠিন হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই স্বীকৃতির ফলে একটি নতুন কূটনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হতে পারে।

প্রশ্ন ওঠে, ইউরোপীয় দেশগুলো কেন এখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলা এবং তার পরপরই ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ঘটনায়। ওই হামলার নৃশংসতা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর আঘাত, বিশ্ব জনমতের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। ইউরোপীয় নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। মিডিয়াতে উঠে এসেছে গাজার ধ্বংস, দুর্ভিক্ষ, শিশুদের মৃত্যু এবং ইসরায়েলের দখলদার নীতির ভয়াবহ চিত্র।

এ পরিস্থিতি ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের জন্য নৈতিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। তারা বলছেন, এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরও নৈতিক ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব জনমত পাল্টাচ্ছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি পাচ্ছে একের পর এক দেশের কাছ থেকে, আর তখন যুক্তরাষ্ট্র একাকীত্বে পড়েছে। এটি শুধু কূটনৈতিক সংকট নয়, একটি নৈতিক প্রশ্নও বটে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো রাষ্ট্র যখন ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্রত্বের স্বীকৃতি দিতে অনীহা দেখায়, তখন সেটি পশ্চিমা মূল্যবোধের ওপর প্রশ্ন তোলে।

জনমতের সমর্থনও ক্রমশ বেড়ে চলেছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। এই বহুমুখী চাপের মুখে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরাও তাদের কূটনীতি পুনর্গঠন করার চিন্তা করবে। আর তখন ফিলিস্তিন নতুন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে।

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ খবর

আন্তর্জাতিক - এর সব খবর



রে