ঢাকা, সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে ১০ হাজার কোটি টাকার ইকুইটি ফান্ডের প্রস্তাব

২০২৫ ডিসেম্বর ১৫ ১৭:০০:১৮
শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে ১০ হাজার কোটি টাকার ইকুইটি ফান্ডের প্রস্তাব

নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দেশের শেয়ারবাজারে তারল্য বৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন এবং ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ৪ শতাংশ ভর্তুকিযুক্ত সুদে ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার আরও একটি তহবিল গঠনের সুপারিশ।

কমিটির প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বর্তমান ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে একাধিক কর প্রণোদনাও প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত রাখা।

অন্যান্য কর সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলধনী আয় বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর করের হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, সম্পদ-সমর্থিত সিকিউরিটিজে ২০ শতাংশ কর রেয়াত প্রদান এবং মিউচুয়াল ফান্ডের কর ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো।

প্রতিবেদনটিতে শেয়ারবাজারের কাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ সংস্থা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) পুনর্গঠন এবং স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

এই সুপারিশগুলো সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম সাদিকুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন যে, বাজার উন্নয়ন ও কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোই তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

প্রধানউপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরীকে প্রধান করে চলতি বছরের মার্চ মাসে চার সদস্যের এই কমিটি গঠিত হয়। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিএসইসির কমিশনার ফারজানা লালারুখ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ সিদ্দিকী অবশ্য বর্তমান শেয়ারবাজারের সমস্যার জন্য দেশের 'অনিশ্চিত' অর্থনীতি এবং বিগত দুই বছরে নতুন বিনিয়োগের অভাবকে দায়ী করেছেন। তার মতে, স্থিতিশীল ও নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তহবিল গঠন বা অর্থ বরাদ্দ বাজারের জন্য সহায়ক হবে না, কারণ বাজারের আস্থা নির্বাচিত সরকার এলেই দীর্ঘমেয়াদে বাড়বে।

তহবিল ব্যবস্থাপনা ও সম্প্রসারণ

প্রস্তাবিত ১০ হাজার কোটি টাকার তহবিলটি কেবলমাত্র ইকুইটি বা শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করা হবে এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকবে আইসিবির হাতে। পেশাদার পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপক দল এই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেবে এবং এর কার্যক্রম তদারকির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, আইসিবি ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটি কাজ করবে। এছাড়া, আইসিবির ইকুইটি ভিত্তি মজবুত করতে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য বর্তমানে যে ১ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল আছে, তা আরও ২ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ৪ শতাংশ ভর্তুকিযুক্ত সুদে মার্জিন ঋণ নিতে পারে। তবে আইসিবির অতীত পারফরম্যান্স পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠনের পরেই নতুন তহবিল আইসিবির হাতে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ফারুক আহমদ সিদ্দিকী, যেহেতু আইসিবি নিজেই ঋণগ্রস্ত।

প্রাতিষ্ঠানিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর কৌশল

কমিটি স্টক ডিলার, মার্কেট মেকার, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, অ্যাসেট ম্যানেজার এবং ফান্ড ম্যানেজারদের মতো বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো ১২ বছরের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অংশীদারিত্ব বর্তমান প্রায় ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। এ ছাড়া, ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে তালিকাভুক্ত করার জন্য মূলধন সংগ্রহ সংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধনেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

অন্যান্য প্রস্তাবে জাতীয় সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় প্রকল্পের সুদের হারকে ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় মুনাফার সঙ্গে যুক্ত করে যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি, বিমা কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং বিএসইসি, বিআইসিএম ও বিএএসএমের মাধ্যমে দেশব্যাপী আর্থিক সাক্ষরতা কার্যক্রম জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ফারুক আহমদ সিদ্দিকী যুক্তি দেন যে, লাভজনক না হলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ট্রেজারি বিল বা বন্ডের মুনাফা ছেড়ে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে আসবে না।

ফ্লোর প্রাইস বাতিল ও করপোরেট সুশাসন

কমিটি বাজার স্থিতিশীলতা ফেরাতে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস পুরোপুরি বাতিল করার এবং আইপিওর পর তালিকাভুক্তির প্রথম দিন থেকেই সব ধরনের লেনদেন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র বেক্সিমকো ও ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস কার্যকর রয়েছে। এছাড়া, কোম্পানির ঋণ গ্রহণের সীমা তাদের ইকুইটি ক্যাপিটালের ২৫০ শতাংশে বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কোম্পানিগুলোকে ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে উৎসাহিত করবে।

বাজার স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী বা উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি নিয়ন্ত্রক সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিএসইসি, আইডিআরএ ও এফআরসির প্রতিনিধিরা থাকবেন। বছরে কমপক্ষে দুবার এই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

'জেড' কোম্পানির জন্য নতুন নিয়ম ও বিএসইসি শক্তিশালীকরণ

কমিটি 'জেড' শ্রেণির কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে অন্তত ৩০ শতাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার জন্য করপোরেট গভর্ন্যান্স কোড সংশোধনের সুপারিশ করেছে। যদি কোনো কোম্পানি দুই বছরের মধ্যে উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ না হয়, তবে একজন স্বতন্ত্র পরিচালককে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

বিএসইসিকে শক্তিশালী করতে নীতি ও বিধিমালা পর্যালোচনা, তদারকি ও প্রয়োগ, বাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের সাক্ষরতা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন পর্যবেক্ষণের জন্য একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠনেরও সুপারিশ করা হয়েছে। অসদাচরণ বা অযোগ্যতার কারণে তাদের অপসারণের জন্য বিচারিক তদন্তের বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে। বিএসইসির চেয়ারম্যানের মর্যাদা আপিল বিভাগের বিচারপতির এবং কমিশনারদের মর্যাদা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমতুল্য করার প্রস্তাবও রয়েছে। এ বিষয়ে ফারুক আহমদ সিদ্দিকী মনে করেন, কেবল সার্চ কমিটি যথেষ্ট নয়; সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া নির্দলীয় ও দক্ষ লোকের নিয়োগই গুরুত্বপূর্ণ।

বাজার স্থবিরতার ৮টি মূল কারণ

কমিটি শেয়ারবাজারের এই মন্দাবস্থার জন্য আটটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে: দুর্বল মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকে উচ্চ সুদের হার, প্রণোদনা প্রত্যাহার, জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফা, মূল্যস্ফীতি, আস্থার সংকট, ব্যাংকনির্ভর অর্থায়ন এবং মিউচুয়াল ফান্ড ও যৌথ বিনিয়োগ স্কিমের মাধ্যমে কম তহবিল সংগ্রহ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নত বাজারগুলোতে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশ ৭০-৮০ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে এটি মাত্র ২০ শতাংশ। এছাড়া, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগকারীদের স্থায়ী আমানতের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় শেয়ারবাজারে আকর্ষণ কমেছে। খুচরা বিনিয়োগকারীদের ওপর কর আরোপ ও করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা প্রত্যাহারের মতো প্রণোদনা কমানোর ফলেও বাজারের গতি কমেছে।

এছাড়াও, বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের নজরদারি থাকা সত্ত্বেও কারসাজি ও গোষ্ঠীগত আচরণে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোতে সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতিও এই আস্থাহীনতা বাড়িয়েছে। কমিটি উল্লেখ করেছে যে, স্বল্প ইকুইটি থাকা সত্ত্বেও কোম্পানিগুলোর ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার সীমাহীন সুযোগ থাকায় তারা শেয়ারবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহের প্রয়োজন বোধ করছে না, যা বাজারের দুর্বলতার একটি প্রধান কারণ।

এমজে/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে