ঢাকা, শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

নারী পরিচালক ছাড়াই ৬২% কোম্পানি, বিএসইসির কঠোর হুঁশিয়ারি

২০২৫ ডিসেম্বর ১২ ০৭:১৮:৩৭
নারী পরিচালক ছাড়াই ৬২% কোম্পানি, বিএসইসির কঠোর হুঁশিয়ারি

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের বড় অংশ এখনো নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জানিয়েছে, এর ফলে অননুমতি-অবলম্বনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) রাজধানীতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইনস্টিটিউট (আইক্যাব) আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে বিএসইসি কমিশনার ফারজানা লালারুখ বলেন, ৩৬০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৩৮টি প্রতিষ্ঠান নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করেছে। যদিও কমিশন সময়সীমা বাড়িয়ে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দিয়েছে, তবুও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলক এ নিয়ম মানেনি।

২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল জারি করা গেজেট অনুযায়ী, প্রতিটি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ২০২৫ সালের ২৯ এপ্রিলের মধ্যে অন্তত একজন নারী স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করতে বলা হয়েছিল। ওই সময়সীমা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় পরে তা বাড়ানো হয়।

বিএসইসি কমিশনার আরও জানান, করপোরেট গভর্নেন্সে দীর্ঘদিনের নানা দুর্বলতা রয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনো নিয়ম মেনে কোম্পানি সেক্রেটারি নিয়োগ নেই, এমনকি কেউ কেউ সিএফওকে সেক্রেটারি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে—যা সম্পূর্ণ অননুমোদিত।

তিনি বলেন, “অনেক অননুমতি প্রতিষ্ঠান ব্যাকবেঞ্চারের মতো আচরণ করে। বিএসইসি এখন বেবিসিটার নয়—আমরা প্রকৃত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে চাই।”

আইক্যাব ও ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) যৌথভাবে আয়োজিত "অ্যাডভান্সিং ইনক্লুসিভ গভর্নেন্স – ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টরশিপ" শীর্ষক বৈঠকে আইক্যাব সভাপতি এনকে এ মোবিন, এফসিএ, সভাপতিত্ব করেন। আইক্যাবের জেন্ডার ইনক্লুশন অ্যান্ড লিডারশিপ কমিটির চেয়ারম্যান জেরিন মাহমুদ হোসেন, এফসিএ, অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

ফারজানা লালারুখ বলেন, দেশে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো নারীর নেতৃত্বে প্রভাব ফেলে, যা বোর্ডে নারীর উপস্থিতি কমিয়ে রাখে। অনেক পারিবারিক মালিকানার প্রতিষ্ঠানে স্বতন্ত্র পরিচালকদের কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ সীমিত; দুর্বল কমপ্লায়েন্স ও প্রশিক্ষণের অভাব এর বড় কারণ। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে গভর্নেন্স শক্তিশালী, সেখানে স্বাধীন পরিচালকরা দায়িত্ব পালনে সফল হন।

তিনি আরও জানান, বিএসইসি নারী স্বতন্ত্র পরিচালকের একটি শক্তিশালী পুল তৈরি করছে এবং যোগ্য নারী প্রার্থীর সংখ্যা বাড়লে নিয়োগের কিছু শর্ত শিথিল করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।

মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বিএসইসির অনুমোদন পেতে দেরি হয়। তাই আরও স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা দরকার।

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মানজুর বলেন, “স্বতন্ত্র পরিচালকরা ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারদের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। নারীর উপস্থিতি বোর্ডকে আরও বৈচিত্র্যময় ও কার্যকর করে। বোর্ডকে ক্ষমতায়িত করলে ভালো গভর্নেন্স ও মুনাফা—উভয়ই বাড়ে।”

আইক্যাব সভাপতি এনকে এ মোবিন বলেন, audit committee-তে কোনো স্বতন্ত্র পরিচালক তিন মেয়াদ শেষে চেয়ারম্যান হতে না পারার নিয়মটি পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। প্রতিটি বোর্ডে অন্তত একজন ফাইন্যান্স বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট–কোয়ালিফাইড পরিচালক থাকা জরুরি। তিনি আরও বলেন, ESG রিপোর্টিংসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো অনেক পরিচালক প্রশিক্ষণের অভাবে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।

এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, নারী স্বতন্ত্র পরিচালক বোর্ডের বৈচিত্র্য ও ভারসাম্য আনে। কিন্তু বিএসইসির অতিরিক্ত কাগজপত্রের চাহিদা কখনো কখনো জটিলতা তৈরি করে। তাই সব পরিচালকের প্রশিক্ষণ জরুরি।

আইসিএসবির সভাপতি হোসেন সাদাত বলেন, পরিচালক নিয়োগ অবশ্যই পেশাগত দক্ষতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। রাজনৈতিক বা পারিবারিক প্রভাবের সুযোগ রাখা যাবে না। AGM-এ স্বতন্ত্র পরিচালকদের মতামত দেওয়ার সুযোগ বাড়ানোর ওপরও তিনি গুরুত্ব দেন।

ইকনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি দৌলত আখতার মালা বলেন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বর্তমান যোগ্যতার শর্তগুলো কিছুটা কঠোর; নমনীয় করা হলে অংশগ্রহণ বাড়বে। পাশাপাশি বোর্ডে নারীর উপস্থিতি ৫০:৫০ অনুপাতে আনার আহ্বান জানান তিনি।

গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের এমডি ও সিইও ফারজানা চৌধুরী বলেন, পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নারীরা বাস্তব নেতৃত্বে দক্ষ হলেও শিক্ষাগত যোগ্যতা অনেক সময় সীমিত থাকে। তাই তাদের নিয়োগে বিশেষ বিবেচনা থাকা উচিত।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজ (বিএপিএলসি)-এর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল পলিমারের এমডি রিয়াদ মাহমুদ বলেন, কোম্পানিগুলো নিয়ম মানতে চাইলেও বাস্তব প্রক্রিয়ায় নানা বাধা আছে। যোগ্য নারী পাওয়া গেলেও অনেকেই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন; আবার গ্রহণ করলেও সব শর্ত পূরণে সমস্যা হয়। তিনি মনে করেন, শর্ত কিছুটা শিথিল হলে অনেক প্রতিষ্ঠান সহজেই নিয়ম মানতে পারবে।

আইএফসির ইএসজি কর্মকর্তা লোপা রহমান বলেন, বিশ্বব্যাপী গবেষণা বলছে—বোর্ডে নারীর উপস্থিতি যত বেশি, কোম্পানির আর্থিক কর্মক্ষমতা ও গভর্নেন্স তত শক্তিশালী হয়।

আইক্যাবের জিএইচএলসি সদস্য সাংজিদা কাসেম জানান, তাদের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে বর্তমানে ২১ জন নারী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নয়টি খাতের বিভিন্ন বোর্ডে কাজ করছেন। আরও ১৩৪ জন নারী এফসিএ স্বতন্ত্র পরিচালক হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আইক্যাব নারী নেতৃত্ব গড়তে একটি শক্তিশালী পাইপলাইনও তৈরি করেছে।

আইক্যাব ও আইএফসি জানান, নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো কেবল নিয়ম পূরণের বিষয় নয়; এটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী গভর্নেন্স ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যেই তারা নিয়ন্ত্রক সংস্থা, পেশাজীবী সংগঠন ও করপোরেট খাতের নেতাদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাবে।

সালাউদ্দিন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে