ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Sharenews24

৯ বছর ধরে এক ভুয়া বিচারক, বছরে দিয়েছেন ৫০০ রায়

২০২৪ অক্টোবর ৩০ ১৪:৪২:৩৭
৯ বছর ধরে এক ভুয়া বিচারক, বছরে দিয়েছেন ৫০০ রায়

ডেস্ক রিপোর্ট: বিবিসির অনলাইনে ভারতের গুজরাটের রাজধানী গান্ধীনগরের খবরটি দিয়েছে। এতে কয়েক বছর ধরেই এক ব্যক্তির ভুয়া আদালত পরিচালনা করার লোমহর্ষক তথ্য উঠে এসেছে।

খবরটি চলচ্চিত্রের গল্পকে হার মানিয়ে দিয়েছে। যার কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্থাৎ সেই ভুয়া সালিশি আদালতের বিচারক এখন পুলিশের হেফাজতে।

বিবিসি জানিয়েছে, মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান নামে ওই ব্যক্তিকে সম্প্রতি আদালতে পেশ করে পুলিশ। সেখানেও তিনি নিজেকে সালিশি আদালতের জাজ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন।

ওই ব্যক্তি বিচারকের কাছে অভিযোগ করেছেন, পুলিশ তাকে মারধর করেছে এবং বাধ্য করেছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করতে। এরপর, তার ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশ দেন আদালত।

মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ভুয়া আদালত গঠন এবং জালিয়াতি করে রায় দেওয়ার অভিযোগে অবিলম্বে প্রতারণা ও ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেন সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক জয়েশ এল চৌতিয়া।

আদালত তাকে ১০ দিনের জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কীভাবে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করছিলেন নিজেকে সালিশি বিচারক বলে দাবি জানানো এই ব্যক্তি এবং কী করে তিনি এত বছর এই নকল আদালত চালিয়ে এসেছেন, সে বিষয়ে জানতে এই মামলার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবী ও এক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি গুজরাটি।

পুলিশ জানায়, মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান আইনে পিএইচডি করেছেন। আহমেদাবাদ, ভদোদরা ও গান্ধীনগরে জমি বিবাদে সালিশি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি।

আহমেদাবাদ জোন-২ এর ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বিবিসিকে বলেছেন, মরিস ক্রিশ্চিয়ান আদতে সবরমতীর বাসিন্দা। কয়েক বছর আগে গান্ধীনগরে ভুয়া আদালত খোলেন মরিস।

এরপর পুলিশ অভিযোগের জেরে সেই আদালতের ঠিকানা বদলে ফেলতে বাধ্য হন তিনি। বর্তমানে গান্ধীনগরের সেক্টর ২৪-এ একটা ভুয়া আদালত চালাচ্ছিলেন তিনি।

বিবিসিকে পুলিশ আরও জানায়, সিটি সিভিল কোর্টে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান স্বীকার করেছেন, তিনি গত এক বছরে গান্ধীনগর, আহমেদাবাদ ও ভদোদরা মিলিয়ে ৫০০টি বিতর্কিত জমি সংক্রান্ত মামলার রায় দিয়েছেন।

স্যামুয়েল ফার্নান্দেজ নামে মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের এক প্রতিবেশী বিবিসিকে বলেন, ছেলেবেলা থেকেই অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখতেন মরিস। লোকজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। মরিসের মা গোয়ার বাসিন্দা ছিলেন আর বাবা রাজস্থানের।

স্যামুয়েল ফার্নান্দেজ বলেন, অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নেন মরিস কিন্তু কখনও ফেরত দেননি। এ অভ্যাসের কারণে সবরমতীর সবাই তার কাছ থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন।

তার মতে, বড় কর্মকর্তাদের মতো জীবনযাপন করতেন মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান। তিনি গাড়িতে ভ্রমণ করতেন। এমনকি তার ব্যাগ ধরে রাখার জন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ শুরু করে সরকার। কারণ ছিল আদালতে দায়ের হওয়া বিপুল সংখ্যক মামলার বোঝা। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মামলা নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারী ও আইনজীবী নিয়োগ করা হয়।

সেই সময় মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ান সালিশির প্রশংসাপত্র পান। এরপরই প্রথমে গান্ধীনগরের সেক্টর-২১-এ তার ভুয়া আদালত শুরু করেন।

আদালত পরিচালনার জন্য তিনি বিচারকের আসনেরও ব্যবস্থা করেন। আদালতে একজন বিচারককে যেমন আসনে দেখা যায়, তেমনই একটি চেয়ার কেনেন তিনি। এরপর দুজন টাইপিস্ট এবং জামিনদারও নিয়োগ করেন ।

ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের আইন বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট দীপক ভাট বিবিসিকে বলেন, আদালতের মতো আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা সালিশের নেই। আদালত দ্বারা অনুমোদিত হলে তবেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে আসা চুক্তি বৈধ হবে।

গুজরাটের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (ডিসিপি) শ্রীপাল শেশমা বলেন, সেক্টর ২১ এ ভুয়া আদালত চালানোর সময় মরিসের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল।

তিনি জানান, অভিযোগের পর মরিস রাতারাতি ২১ নম্বর সেক্টরের অফিস খালি করে ২৪ নম্বর সেক্টরে একটি আদালত শুরু করে দেন।

গুজরাট বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ও আইনজীবী অনিল কেলা বিবিসি গুজরাটিকে বলেন, আমরা মরিস স্যামুয়েল ক্রিশ্চিয়ানের ডিগ্রির বিষয়ে জানতে ছেয়েছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন, বিদেশে পড়াশোনা করেছেন এবং তার কাছে এমন ডিগ্রি রয়েছে যে, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি আইনজীবী হিসাবে প্র্যাকটিস করতে পারবেন।

আইনজীবী অনিল কেলা বলেন, আমাদের প্রথম সন্দেহ ছিল এই কথা ভেবে যে, এত উঁচু ডিগ্রিধারী একজন ব্যক্তির সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করা উচিত। তিনি নিম্ন আদালতে কেন প্র্যাকটিস করবেন? এরপর তার ডিগ্রি সংক্রান্ত নথি খতিয়ে দেখা হয়।

তিনি আরও বলেন, বার কাউন্সিল যখন তার ডিগ্রির বিষয় খতিয়ে দেখে তখন জানা যায় সেগুলো সবই জাল। এর ভিত্তিতেই তিনি চার্টারের (দলিল বা সনদ) জন্য আবেদন করেছিলেন। এমনকি ওকালতি করার জন্যও তার প্রয়োজনীয় নথি ছিল না। তাই আমরা ২০০৭ সালে ক্রাইম ব্রাঞ্চে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করি।

আহমেদাবাদ পুলিশ জানায়, আহমেদাবাদ ক্রাইম ব্রাঞ্চে অভিযোগ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে চাঁদখেদা থানায় এবং ২০১৫ সালে মণিনগর থানায় জাল নথির অভিযোগে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়।

গুজরাট সরকারের আইনজীবী ভিবি শেঠ বিবিসিকে বলেন, আমি যখন মামলাটি দেখি, তখন দেখতে পাই, আদেশে লেখা রয়েছে, সরকার অবৈধভাবে বাবু ঠাকুরের জমি নিয়েছে। আট থেকে দশ লাইনের এ আদেশে জমির আয়তন, জমি কার নামে করা রয়েছে এবং তা কখন করা হয়েছে সেই বিষয়ে কোনো উল্লেখ ছিল না। শুধু তাই নয়, স্ট্যাম্প পেপারে কিন্তু ওই আদেশ ছিল না। এরপর পুরো বিষয়টা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়।

আইনজীবী ভিবি শেঠ বলেন, আমরা যখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করি, তখন আদালত থেকে জানা যায় মরিস ক্রিশ্চিয়ানের কাছে সালিশির জন্য প্রয়োজনীয় পদ ছিল না। কারণ তাকে নিয়ে হাইকোর্টের ১১ ধারা অনুযায়ী সালিশির জন্য নিয়োগ নিয়ে কোনো আদেশ ছিল না। নিজেই স্পিড পোস্টের মাধ্যমে মামলার জন্য হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতেন মরিস।

এরপর ঠাকুরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, আমরা যখন বাবু ঠাকুরের আইনজীবী ক্রিস্টিনা ক্রিশ্চিয়ানকে জেরা করি, তখন তিনি আদালতে স্বীকার করে নেন যে তিনি ফৌজদারি মামলার আইনজীবী, দেওয়ানি মামলার আইনজীবী নন। ভিবি শেঠ বলেন, এরপর আমরা তদন্ত করে দেখি যে মরিস ক্রিশ্চিয়ানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। সরকারি জমি দখলের জন্য যে এমন ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে যায়।

মিজান/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ খবর

আন্তর্জাতিক - এর সব খবর



রে