ঢাকা, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

রূপালী ব্যাংকের বিপজ্জনক ঋণ: অর্ধেক ঋণই এখন খেলাপি

২০২৫ ডিসেম্বর ১৭ ০৯:২৫:০০
রূপালী ব্যাংকের বিপজ্জনক ঋণ: অর্ধেক ঋণই এখন খেলাপি

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংক তাদের ৩২ জন বড় গ্রাহককে নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে বিশেষ সুবিধায় বড় অংকের ঋণ দিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছে। এই ৩২টি বড় ঋণ হিসাব থেকেই ব্যাংকটির ১৪ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী কোনো একটি একক গ্রুপ বা গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই, অথচ রূপালী ব্যাংক বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে এই সীমা অতিক্রম করে ঋণ বিলিয়েছে।

প্রাপ্ত নথিপত্র অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংকের ৪৭ জন গ্রাহককে ব্যাংকের সংবিধিবদ্ধ মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে, যাদের 'বড় ঋণগ্রহীতা' হিসেবে গণ্য করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩২ জন গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৬৩ শতাংশ আটকা পড়েছে। ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, সমস্যাযুক্ত এই ঋণের বেশিরভাগই তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আগে অনুমোদিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আদায় প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে এবং অনেক গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি পুনঃতফসিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

খেলাপি ও মূলধন পরিস্থিতি রূপালী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ১৬ জন শীর্ষ খেলাপির কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। তবে ২০২৫ সালের জুন নাগাদ ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ এক লাফে ২২ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় (মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ) পৌঁছায়। সেপ্টেম্বর নাগাদ এই হার আরও বেড়ে ৫১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যার অংক ২৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই মোট খেলাপি ঋণের ৫৫ শতাংশ আটকা পড়ে আছে। অথচ গত জুন পর্যন্ত এই শীর্ষ গ্রাহকদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৭ শতাংশ বা ৯০ কোটি টাকা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

আর্থিক সংকটের গভীরতা বোঝা যায় ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি দেখে। জুন শেষে ব্যাংকটির প্রয়োজনীয় মূলধন ছিল ৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা, কিন্তু প্রকৃত মূলধন দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ১৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকায়। ফলে ব্যাংকটিতে বর্তমানে ২৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকার বিশাল মূলধন ঘাটতি রয়েছে।

শীর্ষ ১১ খেলাপি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির বড় খেলাপিদের তালিকায় রয়েছে দেশের নামী-দামী সব গ্রুপ। এর মধ্যে ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপ (১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা), বেক্সিমকো লিমিটেড (৯৯০ কোটি টাকা), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (৯০০ কোটি টাকা), ক্রনি অ্যাপারেলস (৮৫০ কোটি টাকা) এবং জুট টেক্সটাইল মিলস (৭২০ কোটি টাকা) অন্যতম। এছাড়া এমএসএ টেক্সটাইল, ইউনিট্যাক্স গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, এএ নিট স্পিন, মাদারীপুর স্পিনিং এবং ডলি কনস্ট্রাকশনের কাছেও শত শত কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে।

শাখাভিত্তিক ঋণের কেন্দ্রীভবন আশ্চর্যের বিষয় হলো, রূপালী ব্যাংকের সারা দেশে ৫৮৬টি শাখা থাকলেও মোট ঋণের ৫৫ শতাংশেরও বেশি বিতরণ করা হয়েছে মাত্র ৫টি শাখা থেকে। এর মধ্যে কেবল 'লোকাল অফিস' শাখা থেকেই দেওয়া হয়েছে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নির্দিষ্ট কিছু শাখাকে ব্যবহার করে এই বড় অংকের ঋণগুলো বের করা হয়েছে, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, একক ঋণগ্রহীতার সীমা রাখা হয় ঝুঁকি কমাতে। কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং এস আলম বা বেক্সিমকোর মতো বড় গ্রুপের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বা নিত্যপণ্যের সংকটের দোহাই দিয়ে বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যা এখন ব্যাংকটির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় ৫৯৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটির গভীর আর্থিক সংকটেরই প্রতিফলন।

সালাউদ্দিন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে