ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

ব্যাংকিং খাতে সর্বনাশ: সাবেক তিন গভর্নরের নেতৃত্বে হারালো কোটি কোটি টাকা

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯ ০৯:২১:১৭
ব্যাংকিং খাতে সর্বনাশ: সাবেক তিন গভর্নরের নেতৃত্বে হারালো কোটি কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের বর্তমান দুর্দশা এবং এর জন্য দায়ী সাবেক তিন গভর্নর—আতিউর রহমান, ফজলে কবির, এবং আব্দুর রউফ তালুকদারের ভূমিকা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এই তিনজনই তাদের দায়িত্ব পালনকালে ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারকে সম্ভব করে তুলেছিলেন।

১. আতিউর রহমান (২০০৯-২০১৬)

আতিউর রহমান ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আমলে ব্যাংক খাতে দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা এবং অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়। তার সময়ে হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটে, যেখানে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২,৭০০ কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে তুলে নেওয়া হয়। এটি ছিল দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা। এর ফলস্বরূপ, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তন করা হলেও, পরে ২০১৪ সালে বেসিক ব্যাংক এও জালিয়াতি ঘটে, যেখানে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা লোপাট হয়।

আতিউর রহমানের আমলে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপও দেখা যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে ৯টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে ব্যাংক খাতে আরো দুর্নীতি বৃদ্ধি করে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আতিউর রহমানের দায় অনেকটা স্পষ্ট হয়। এই ঘটনায় তার ভূমিকা সন্দেহজনক ছিল এবং পরে তিনি পদত্যাগ করেন।

২. ফজলে কবির (২০১৬-২০২০)

আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর ২০১৬ সালে ফজলে কবির বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার আমলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আরো একাধিক বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে। ফজলে কবিরের অধীনে এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) দখল করে নেয়। এই দখলের পর, ব্যাংকগুলোতে ব্যাপক লুটপাট শুরু হয় এবং এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক হস্তক্ষেপ বাড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে এস আলম গ্রুপের প্রভাব ছিল অসীম। ফজলে কবিরের আমলে ঋণ নীতিমালায় ছাড় দেওয়া হয়, যার ফলে খেলাপি ঋণ গোপন করার সুযোগ তৈরি হয়। একই সময় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা ব্যাংক খাতে আরও অনিয়ম বাড়িয়ে দেয়।

৩. আব্দুর রউফ তালুকদার (২০২২-২০২৫)

২০২২ সালে আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সময়ে ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর ঋণখেলাপিদের জন্য এক নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ অনেকটা সহজ করে দেওয়া হয়। পূর্বে যেখানে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ টাকা জমা দিতে হত, সেখানে নতুন নীতিমালায় তা ২.৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

এছাড়া, তার আমলে এস আলম গ্রুপ আবারও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়, এবং রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়ার কাজও বেড়ে যায়। তার সময়েও ব্যাংক খাতের নানা আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করা হয় এবং সাংবাদিকদের ব্যাংকিং বিষয়ক তথ্য প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে, ব্যাংক খাতে আরও অনেক অনিয়ম ঘটতে থাকে। তিনি পরবর্তীতে পদত্যাগ করেন, তবে তার যোগাযোগের মাধ্যমে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত শ্বেতপত্রে ব্যাংক খাতের পরিণতিকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যেখানে দুর্নীতির কারণে ব্যাংক খাতের সর্বশেষ ঋণের পরিমাণ ৬,৭৫,০০০ কোটি টাকা ছুঁয়েছে।

এছাড়া, ব্যাংক খাতের উপর এক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং রাজনৈতিক চাপের মাধ্যমে ব্যাংক দখল করা ছিল আরো একটি বড় ঘটনা। এসব দুর্নীতি ও অর্থপাচার বর্তমানে দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই তিন গভর্নর ছাড়াও, তাদের অধীনে দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি গভর্ন, বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এর সাবেক প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি উঠেছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত ধ্বংসের অন্যতম দায়ী সাবেক তিন গভর্নর এবং তাদের সহযোগীরা এখনও বিচার বহির্ভূত রয়ে গেছেন, এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অভাবে ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে আরও দুর্নীতির শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত এসব দুর্নীতিবাজদের বিচার নিশ্চিত করা, যাতে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনগণের অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।

কেএইচ/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে