ঢাকা, সোমবার, ৬ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

সব মিলিয়ে ডুবছে দেশের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক!

২০২৫ অক্টোবর ০৬ ০৯:৫৬:৫৪
সব মিলিয়ে ডুবছে দেশের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক!

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও দুঃশাসনের কারণে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। প্রায় দেড় দশক ধরে এই ব্যাংকটি শিকদার পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই সময়ে প্রতিষ্ঠানটি নানা বেনামি ঋণ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতির কারণে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। শিকদার পরিবারের দেশত্যাগ ও সরকারের পরিবর্তনের পর ব্যাংকটি তাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলেও আর্থিক অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে আরো নাজুক হয়ে উঠেছে।

২০২৪ সালের ২০ আগস্ট ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্যবসায়ী ও বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু। নতুন নেতৃত্বে ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে— এমন প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং ব্যাংকটির আমানত, ঋণ আদায়, মূলধন ও তারল্য পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত ৯ মাসে ব্যাংকটির আমানত কমেছে প্রায় ৫ হাজার ২০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩২ হাজার ৬১০ কোটি টাকায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্যক্তি আমানতের ক্ষেত্রে।

অন্যদিকে, এই ৯ মাসে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। যেখানে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৫৫.৪৯%), তা বেড়ে ২০২৫ সালের জুনে দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৬৬.২৪%)। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ৩৮৮ কোটি টাকা। অথচ এখন তা দেশের সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণধারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণে ব্যাংকটি এখন বড় ধরনের প্রভিশন ঘাটতির মুখে পড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১৬ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের জুনে বেড়ে হয়েছে ২২ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। একই সময়ে মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায়। এই ঘাটতি পূরণে ব্যাংকটির সক্ষমতা না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ধার নিয়েও সংকট কাটছে না।

বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ব্যাংকটি ভয়াবহ সংকটে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে তাদের মোট দায়ের (মূলত আমানতের) ৪% নগদ আকারে এবং ১৩% ট্রেজারি বিল বা বন্ডে রাখতে হয়। অথচ ন্যাশনাল ব্যাংক সিআরআর (নগদ জমা) ঘাটতিতে রয়েছে ১ হাজার ২৫২ কোটি টাকা এবং এসএলআর (বন্ড ইত্যাদি) ঘাটতিতে রয়েছে ৪ হাজার ১০ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে এসব ঘাটতির জন্য ব্যাংকটিকে প্রতিনিয়ত জরিমানাও গুণতে হচ্ছে।

অবনতির আরেকটি বড় দিক হলো নিট সুদ আয়ের নেতিবাচক প্রবণতা। আমানতের বিপরীতে সুদ দিতে হলেও, ঋণের বিপরীতে সুদ আদায় হচ্ছে না বললেই চলে। এর ফলে ব্যাংকের নিট সুদ আয় ঋণাত্মক দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৯৯১ কোটি টাকা, যেখানে গত বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ৬৫২ কোটি। আর ২০২৪ সালের পুরো বছরেই ব্যাংকটির লোকসান ছিল ১ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।

পরিস্থিতির চরমতা বোঝা যায় ব্যাংকটির ধার নেওয়ার ইতিহাস থেকে। নতুন পরিচালনা পর্ষদের অধীনে ন্যাশনাল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জামানত ছাড়া ৬ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যাংক থেকেও ৯৮৫ কোটি টাকা ধার নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি দিয়ে। এসব অর্থ ফেরত দেওয়ার সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখনো টাকা ফেরত দিতে পারেনি ব্যাংকটি। উপরন্তু, চলতি হিসাবে ঘাটতি রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা ধার নেওয়া হয়েছে, যার মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির এই ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।

শিকদার পরিবারের ছায়া থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলবে— এমনটি আশা করা হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর্থিক সংকট, খেলাপি ঋণ, তারল্য ঘাটতি এবং লোকসানের বেড়ে চলা প্রবণতা দেখে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যদি দ্রুত ও কার্যকর সংস্কার না আসে, তাহলে ব্যাংকটির অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে।

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে