ঢাকা, শনিবার, ৭ জুন ২০২৫
Sharenews24

পোশাক রপ্তানিতে ভারতের বাজিমাত, বাংলাদেশের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

২০২৫ জুন ০৭ ২২:৪৩:৩৫
পোশাক রপ্তানিতে ভারতের বাজিমাত, বাংলাদেশের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নীতিনির্ধারণী অনিশ্চয়তার কারণে বৈশ্বিক ক্রেতারা নতুন গন্তব্যের দিকে নজর ফেরাতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ভারতের তৈরি পোশাক খাত নতুনভাবে গতি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

ভারতের বিখ্যাত গার্মেন্টস কোম্পানি কিটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাবু জ্যাকব এই সাফল্যের পেছনের দিকগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারতের ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (FTA) বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্প শুল্ক সুবিধার ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে।

ভারতের শুল্ক সুবিধা ও কৌশলগত অবস্থান

সাবু জ্যাকব বলেন, "বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ ইউরোপমুখী, যেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। কিন্তু ভারত এখন যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (FTA) সই করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নেও একই ধরনের সুবিধা পেতে জোরালো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।"

তিনি আরও বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চুক্তির আওতায় দেশটি কিছু নির্দিষ্ট পোশাকপণ্যে শূন্য বা স্বল্প শুল্কে রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় যে কঠোর শুল্কনীতি কার্যকর হয়েছিল, তা কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের রপ্তানি হ্রাসে বড় প্রভাব ফেলেছে। ফলে এই শূন্যস্থান পূরণে ভারতীয় পণ্যের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।" বর্তমানে যেসব ভারতীয় পোশাকপণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫-২০ শতাংশ কম শুল্ক হার প্রযোজ্য, তা দেশটির প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও দৃঢ় করছে।

সক্ষমতা বনাম বাস্তবতা: বাংলাদেশ ও ভারত

২০২৪ সালে ভারতের তৈরি পোশাক রপ্তানির সক্ষমতা ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার, যার প্রায় ৯৭ শতাংশই ব্যবহৃত হয়েছে (রপ্তানি ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার)। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সক্ষমতা ৫৬ বিলিয়ন ডলার। তারপরও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রমিক অসন্তোষ ও নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে অনেক ক্রেতাই বিকল্প খুঁজছেন। এই প্রেক্ষাপটে কিটেক্স গার্মেন্টস বিশাল বিনিয়োগে নিজেদের প্রস্তুত করছে।

কিটেক্সের বিশাল বিনিয়োগ ও রেকর্ড প্রবৃদ্ধি

কিটেক্স গার্মেন্টস তেলেঙ্গানায় ৩১ লাখ পিস পোশাক উৎপাদন সক্ষমতার একটি ইউনিট স্থাপনে সাড়ে ৩ হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে ওয়ারাঙ্গল ইউনিটে ইতোমধ্যে উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং হায়দরাবাদ ইউনিট চালু হবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে কিটেক্স গার্মেন্টস ১০২০ কোটি টাকার রেকর্ড রাজস্ব অর্জন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি। প্রতিষ্ঠানটির কর-পরবর্তী মুনাফা ৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫২.৬ কোটি টাকা, যা ১২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে। উৎপাদন দক্ষতা, সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির কারণে এই প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বলে জানান জ্যাকব।

গত এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠানটি তেলেঙ্গানার ওয়ারাঙ্গল ও সিতারামপুরে অবস্থিত কারখানাগুলোর জন্য ২৫ হাজার নতুন নিয়োগের ঘোষণা দেয়। দুই ইউনিটে কিটেক্স ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে এবং প্রতিদিন ২২ লাখ পিস পোশাক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই নেতৃত্ব ধরে রাখতে হলে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং উৎপাদন সক্ষমতার আধুনিকায়ন—এই চারটি খাতেই দ্রুত অগ্রগতি না ঘটালে ভারত, ভিয়েতনাম ও তুর্কির মতো প্রতিদ্বন্দ্বীরা বাংলাদেশের বাজার দখল করে নিতে পারে।

বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডগুলো এখন টেকসই উৎপাদন, কার্যকর শ্রমনীতি এবং স্থিতিশীল সরবরাহ ব্যবস্থার দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমিক আন্দোলন, ন্যূনতম মজুরি ঘাটতি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা বিদেশি ক্রেতাদের উদ্বিগ্ন করছে। এর ফলে অনেক ক্রেতা বিকল্প সরবরাহ উৎস খুঁজতে শুরু করেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে এখনই রাজনৈতিক সহনশীলতা নিশ্চিত, শ্রম আইনের বাস্তব প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল বিনিয়োগ, এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সহজ শর্ত ও স্বচ্ছ নীতিমালা চালুর মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।

এছাড়া জ্বালানি সংকট, বন্দর-ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি এবং বৈদেশিক অর্থনীতির উপর নির্ভরতা বাংলাদেশকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, যদি সময়মতো পরিকল্পনা ও সংস্কার না নেওয়া হয়।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অর্জিত সুনাম ধরে রাখতে হলে এসব ক্ষেত্রে এখন কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি বলে মনে করছেন অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।

মিজান/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে