ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

ঠান্ডা মাথায় প্রতিশোধ নিলেন পুতিন?

২০২৩ আগস্ট ২৫ ১৬:১১:৪৩
ঠান্ডা মাথায় প্রতিশোধ নিলেন পুতিন?

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত জুনের শেষ দিকে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন মস্কোতে রুশ সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দেন। যদিও ২৪ ঘণ্টার বেশি সেই বিদ্রোহের স্থায়িত্ব ছিল না।

এরপর থেকেই রাশিয়ার পর্যবেক্ষকরা প্রিগোজিনকে 'আ ডেড ম্যান ওয়াকিং' বা প্রাণহীন একজন মানুষের মতো বলে বর্ণনা করছিলেন। অর্থাৎ তারা অনুমান করছিলেন প্রিগোজিনের সময় আর বেশিদিন নেই।

সম্প্রতি ভাড়াটে বাহিনীর এই নেতার আয়ু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, আমি যদি প্রিগোজিন হতাম তবে আমি আমার খাবার যিনি পরীক্ষা করেন, তাকে বরখাস্ত করতাম না।

যদি কখনও প্রমাণিত হয় যে ক্রেমলিন ইচ্ছাকৃতভাবে, ঠান্ডা মাথায় প্রিগোজিন বহনকারী বিমানটিকে মধ্য-আকাশে গুলি করে ফেলেছে, তবে এটি রাশিয়ার ইতিহাসে একটি 'বিশেষ সামরিক অভিযান' হিসাবে স্বরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রিগোগিন এক সময়ের দোষী, এক সময়ের বাবুর্চি এবং হট ডগ বিক্রেতা। ভাড়াটে ওয়াগনারের ভিতরে এবং বাইরে অনেক ভক্ত এবং অনুসারী রয়েছে। মাত্র দুই মাস আগে রোস্তভ-অন-ডনে অসমাপ্ত একদিনের বিদ্রোহের সময় সাধারণ মানুষ তাকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছে তা হয়তো অনেকেই দেখেছেন।

তবে মস্কোতে তার অনেক শত্রুও ছিল। বিশেষ করে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ নেতারা। যাকে তিনি ঘন ঘন এবং প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।

কিন্তু সম্ভবত তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বাদ দিয়ে ২৩শে জুন মস্কোতে সেই বিদ্রোহ শুরু করা। তবে তিনি পুতিনের নাম উল্লেখ করেননি।

কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন তার পেছনে মস্কো যে কারণ দেখিয়েছিল তা নিয়ে প্রকাশ্যে কঠোর সমালোচনা করে প্রিগোজিন ক্রেমলিনকে খেপিয়ে তুলেছিলেন।

তিনি রুশদের বলেছিলেন, তারা প্রতারিত হয়েছে এবং দুর্বল নেতৃত্বের কারণে তাদের ছেলেরা ইউক্রেন যুদ্ধে মারা যাচ্ছে। এরপর পুতিন মস্কোতে প্রিগোজিনের অগ্রযাত্রাকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' এবং 'পিঠে ছুরিকাঘাত' বলে অভিহিত করেছিলেন।

বিশ্বাসঘাতক বা যারা তাকে চ্যালেঞ্জ করে তাদের কখনো ক্ষমা করেন না ভ্লাদিমির পুতিন।

ওয়াগনারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে, প্রিগোজিনের ব্যক্তিগত বিমানটিতে গুলি করে ভূ-পাতিত করেছে রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

গ্রে জোন নামে একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলের একটি পোস্টে বলা হয়, প্রিগোজিন রাশিয়ার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার পদক্ষেপের ফল স্বরূপ মারা গেছে। গ্রে জোন চ্যানেলটি ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

এছাড়া মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা ড্যানিয়েল হফম্যান দাবি করেছেন, প্রিগোজিনের মৃত্যু অবশ্যই পুতিনের নির্দেশে হয়েছে।

সিআইএর মস্কো স্টেশনের সাবেক এই প্রধান বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই পুতিনের নির্দেশেই প্রিগোজিনের হত্যা করা হয়েছে।’

সাবেক রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলেকজান্ডার লিটভিনেনকো দলত্যাগী হওয়ার পর তাকে তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম-২১০ এর বিষ দেওয়া হয়েছিল, যার প্রভাবে ২০০৬ সালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি তিলে তিলে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুবরণ করেন।

পরে তদন্তে জানা যায়, এ মারাত্মক পদার্থটি ঘাতকরা রাশিয়া থেকে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল এবং এটি শুধুমাত্র রাশিয়ার সরকারি গবেষণাগারে পাওয়া যায়। যদিও মস্কো ওই ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা কথা অস্বীকার করেছে।

কিন্তু যে দুই সন্দেহভাজনকে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদেরকে বিচারের জন্য আত্মসমর্পণ করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল দেশটি।

প্রায় একই পরিণতি হতে পারতো সের্গেই স্ক্রিপালের সঙ্গেও, যিনি ছিলেন একজন সাবেক রুশ কেজিবি অফিসার এবং পরে তিনি ব্রিটেনে আশ্রয় নেন। ২০১৮ সালে তিনি এবং তার মেয়ে ইউলিয়া অল্পের জন্য মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

জিআরইউ বা রাশিয়ার শীর্ষ গোয়েন্দা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা স্যালসবিউরিতে তার বাড়ির দরজার হাতলে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট লাগিয়ে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। একটি ফেলে দেওয়া পারফিউমের বোতলে এই মারাত্মক এজেন্টটি ছিল।

পরে উইল্টশায়ারের স্থানীয় বাসিন্দা ডন স্টার্জেস বোতলটি খুঁজে পান, যিনি নিজের কব্জিতে সেটি লাগানোর পরপরই মারা যান।

রাশিয়ার অভ্যন্তরে সমালোচক এবং ব্যবসায়ীদের এক দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যারা আকস্মিক মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের কেউ কেউ 'বাড়ির ওপর তলার জানালা থেকে পড়ে' গিয়ে মারা গিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের সবচেয়ে সোচ্চার প্রতিপক্ষ, আলেক্সেই নাভালনি, এখন রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জালিয়াতির অভিযোগে সাজা ভোগ করছেন।

২০২০ সালে তাকেও সাইবেরিয়ার একটি ফ্লাইটে নোভিচক নার্ভ এজেন্ট বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন।

তবে প্রিগোজিনের বিষয়টি একদম আলাদা ছিল, তার মৃত্যুতে রুশ জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি ক্রেমলিনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিলেন এবং অনেক রুশ নাগরিকের কাছে তিনি ছিলেন জাতীয় বীরের মতো।

এর আগে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তার ভাড়াটে সৈন্যের বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপটি মূলত সাবেক রুশ স্পেজনাজ (বিশেষ বাহিনী) অপারেটিভ এবং নিবেদিত প্রাণ সৈন্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল।

এটি পূর্ব ইউক্রেনে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল, যেখানে তারা ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে বাখমুত থেকে বিতাড়িত করেছিল। এতে তারা বড় ধরণের খ্যাতি অর্জন করে। যেখ্যাতি দুর্বল নেতৃত্বের নিয়মিত রুশ সেনাবাহিনী কখনোই পায়নি।

ওয়াগনারের প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে যখন প্রিগোজিন ব্যক্তিগতভাবে রাশিয়ায় দণ্ডিত ধর্ষক এবং খুনিসহ হাজার হাজার সাজাপ্রাপ্তকে নিজের দলে ভেড়াতে শুরু করেন।

পূর্ব ইউক্রেনে এই বাহিনী শক্তিশালী কামানের মতো কাজ করেছিল। যেখানে কমান্ডাররা তাদের শত্রুদের পরাস্ত করতে বার বার এই সৈন্যদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল।

ওয়াগনার কয়েক বছর সিরিয়াতেও কাজ করেছে, কিন্তু মূলত আফ্রিকাতেই তারা ক্রেমলিনের জন্য কৌশলগত সাফল্য বয়ে এনেছিল। সেখানে তারা অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করে, যা সেখানকার অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর কাছে জনপ্রিয় প্রমাণিত হয়।

ভিআইপিদের সুরক্ষা দেওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করানোসহ নানা ধরনের 'নিরাপত্তা পরিষেবা' প্রদানের বিনিময়ে তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে স্বর্ণ এবং বহুমূল্য খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায়।

সেখান থেকে অর্জিত অর্থ মস্কোতে যেত এবং অচিরেই তারা প্রচুর অর্থের মালিক হয়, কিন্তু ওই সব দেশের জনগণের ভাগ্যে প্রকৃত কোন পরিবর্তন হয়নি। মালি এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনারবাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।

তবুও তারা আফ্রিকা মহাদেশের বিশাল এলাকা জুড়ে ফরাসি এবং অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিকে হটিয়ে নিজেদের প্রতিস্থাপনে সফল হয়েছে।

এই সপ্তাহেই টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রিগোজিনের একটি ভিডিও সামনে আসে। ভিডিওটি মালির কোনো ঘাঁটিতে ধারণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সেখানে তাকে বলতে দেখা যায়, ওয়াগনার বাহিনী আফ্রিকায় তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করবে এবং আফ্রিকার মানুষদের 'স্বাধীনতা' এনে দেয়ারও অঙ্গীকার করা হয়।

এসব সত্ত্বেও ওয়াগনারের অনেক অনুসারী মস্কোতে ফিরে আসেন, বিশেষ করে সামরিক গোয়েন্দাদের মধ্যে যারা ওয়াগনারকে এক ধরণের 'দায়বদ্ধতা' বলে মনে করে তারা যে কোনো সময় দুর্বৃত্ত হয়ে পুতিনের জন্য 'সম্ভাব্য হুমকি' হয়ে উঠতে পারে। তথ্যসূত্র: বিবিসি

শেয়ারনিউজ, ২৫ আগস্ট ২০২৩

পাঠকের মতামত:

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ খবর

আন্তর্জাতিক - এর সব খবর



রে