ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
Sharenews24

শেয়ারবাজারে গুজবের অধিপত্য– বিনিয়োগকারীর জন্য নীরব ফাঁদ

২০২৫ আগস্ট ১৪ ১৬:৩৮:৪০
শেয়ারবাজারে গুজবের অধিপত্য– বিনিয়োগকারীর জন্য নীরব ফাঁদ

সাইফুল ইসলাম পিপন: বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার অন্যতম বড় শত্রু হলো গুজব। গুজব কখনো সরাসরি একটি শেয়ারের দামে উর্ধ্বগতি ঘটায়, আবার কখনো হঠাৎ করে ধস নামিয়ে দেয়। এ ধরনের মিথ্যা বা অপূর্ণাঙ্গ তথ্যের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাজারো বিনিয়োগকারী। অথচ এর নেপথ্যের কারিগররা বেশিরভাগ সময় আড়ালেই থেকে যায়।

গুজবের উৎপত্তি হয় মূলত তিনটি জায়গা থেকে— প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম যেমন- ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, যেখানে যাচাইবাছাই ছাড়া খবর ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস— কোম্পানির ভেতরের গোপন বা অসম্পূর্ণ তথ্য যখন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার করা হয়। তৃতীয়ত, বাজার কারসাজি— যেখানে বড় বিনিয়োগকারী বা সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে ভুয়া খবর ছড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

এমন ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব শেয়ারবাজারেই কমবেশি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেমস্টপ শেয়ার নিয়ে Reddit প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত খবরের কারণে কয়েক দিনের মধ্যে শেয়ারের দাম কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী লাভ করলেও, অনেকে শীর্ষ দামে কিনে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। একইভাবে, ভারতে একাধিক কোম্পানির শেয়ার নিয়ে টেলিগ্রাম গ্রুপে ভুয়া খবর ছড়ানোর কারণে বাজার নিয়ন্ত্রক SEBI জরিমানা ও গ্রেপ্তার কার্যক্রম চালাতে বাধ্য হয়।

সোশ্যাল মিডিয়া গুজবের ভয়াবহতা হলো, এটি দ্রুত ছড়ায় এবং বিনিয়োগকারীর আবেগকে প্রভাবিত করে। কেউ লাভের আশায় অযৌক্তিক দামে কিনে ফেলে, আবার কেউ ভয়ের কারণে অল্প দামে বিক্রি করে দেয়। এই আবেগনির্ভর লেনদেনই গুজব কারিগরদের মূল লক্ষ্য।

বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন— প্রেস রিলিজ দিয়ে তথ্য পরিষ্কার করা, নির্দিষ্ট শেয়ারের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির তদন্ত এবং কারসাজি প্রমাণিত হলে জরিমানা আরোপ করা। তবে বাস্তবতা হলো, অনেক বিনিয়োগকারী এখনো যাচাই-বাছাই ছাড়া গুজবের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, যা বিনিয়োগ ঝুঁকি বাড়ায়।

গুজব মোকাবেলায় করণীয়

গুজব দমনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা হতে হবে আরও কঠোর ও প্রযুক্তিনির্ভর। গুজব রটনাকারী ও বাজার কারসাজিতে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান জরুরি, যাতে অন্যরা একই পথে হাঁটার সাহস না পায়। শুধু আর্থিক জরিমানা নয়, প্রয়োজন হলে শেয়ার লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা ও কারাদণ্ডের বিধানও প্রয়োগ করা উচিত।

একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমকে আরও বাস্তবধর্মী ও ধারাবাহিক করতে হবে। অনলাইন ও অফলাইনে সেমিনার, বাজার সচেতনতা সপ্তাহ এবং শিক্ষামূলক কনটেন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের তথ্য যাচাইয়ের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব শনাক্ত ও প্রতিবাদ করার জন্য অফিসিয়াল মনিটরিং টিম সক্রিয় রাখতে হবে, যাতে ভুয়া খবর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রতিহত করা যায়।

এখানে প্রযুক্তির সংযুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্লকচেইন প্রযুক্তি দিয়ে প্রতিটি লেনদেনের স্বচ্ছ রেকর্ড রাখা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দিয়ে তাৎক্ষণিক ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে সন্দেহজনক কার্যক্রম চিহ্নিত করা সম্ভব। এভাবে কারসাজি ও গুজবের উৎস দ্রুত শনাক্ত হবে, তদন্তে সময় কম লাগবে এবং বাজারে স্বচ্ছতা বাড়বে।

শেষ পর্যন্ত, গুজব এক ধরনের নীরব ফাঁদ— যা প্রথমে লাভের মতো মনে হলেও, ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীর মূলধন নিঃশেষ করে দেয়। তাই বিনিয়োগকারীর সুরক্ষার জন্য সচেতনতা, প্রযুক্তি এবং কঠোর শাস্তির সমন্বয় জরুরি। শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে গুজবের এই আধিপত্য ভাঙতেই হবে।

লেখক শেয়ারবাজারের একজন বিশ্লেষক

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে