ঢাকা, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
Sharenews24

গোপন বিয়ে, প্রতারণা, প্রতিশোধ ও পুলিশ হেফাজতে বিষপানে মৃত্যু

২০২৫ জুলাই ১২ ১৩:৪৩:৫২
গোপন বিয়ে, প্রতারণা, প্রতিশোধ ও পুলিশ হেফাজতে বিষপানে মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকার ভাটারা থানায় পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন বিষপানে মৃত্যুবরণ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি)-এর গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্ন্যান্স বিভাগের একজন নারী প্রভাষক ফিরোজা আশরাভী। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ইলিয়াস কামাল রিসাতের বিরুদ্ধে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। এই হৃদয়বিদারক ও জটিল ঘটনা দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার ব্যবস্থার ওপর নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

পুলিশি সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট তদন্তের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ভোররাত আনুমানিক সাড়ে ৩টায় রাজধানীর পল্লবীর একটি বাসায় এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। রিসাতের ঘুমন্ত অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁর যৌনাঙ্গ কেটে দেন ফিরোজা। পরবর্তী সময়ে আহত রিসাতকে চিকিৎসার জন্য ফিরোজা নিজেই বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যান। এই ঘটনার নেপথ্যে ফিরোজা দাবি করেন, তিনি এবং রিসাত চার মাস আগে বিয়ে করেছিলেন, এবং সেই বিয়ের বৈধ কাবিননামাও তিনি পুলিশের সামনে উপস্থাপন করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, বিয়ের সময় রিসাত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি তাঁর আগের স্ত্রীকে তালাক দেবেন, যিনি তখন জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। রিসাত সেইমতো তাঁর প্রথম স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ পাঠান, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর সেই স্ত্রী জার্মানি থেকে বাংলাদেশে ফিরে এলে রিসাত গোপনে পুনরায় তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং উকিলের মাধ্যমে আগের তালাকনামা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন। এই সত্য জানতে পেরে ফিরোজা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন এবং দাম্পত্য কলহ চরমে পৌঁছে যায়, যা পরবর্তীতে শারীরিক সহিংসতায় রূপ নেয়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ফিরোজা বলেন, কথাকাটাকাটি এবং ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তিনি এবং রিসাত উভয়েই আহত হন এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি ওই ভয়ানক কাজটি করেন।

হাসপাতালে ভর্তির পর বিকেলে রিসাতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ফিরোজার বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। একপর্যায়ে বিকেল চারটার দিকে ফিরোজা ৯৯৯-এ ফোন করে জানান, তাঁকে জোরপূর্বক আটকে রাখা হয়েছে এবং তাঁর নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাটারা থানা পুলিশের একটি দল দ্রুত গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। ঠিক সেই সময় পল্লবী থানার পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ফিরোজার বিরুদ্ধে রিসাতের যৌনাঙ্গ কেটে দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে। এ কারণে ভাটারা থানা তাঁকে অস্থায়ীভাবে হেফাজতে রাখে।

পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ফিরোজার আচরণ ছিল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বারবার আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। এরপর দুইজন তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি ‘লিগ্যাল এইড ভলান্টিয়ার’ পরিচয়ে থানায় প্রবেশ করে এবং তাঁর বাসা থেকে মোবাইল চার্জার, ইনহেলারসহ একটি ছোট বোতল নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পর ফিরোজা সেই বোতল থেকে তরল পান করতে থাকলে, দায়িত্বরত নারী কনস্টেবল বিষয়টি আঁচ করে তাঁকে বাধা দিতে গেলে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। বোতলটি থেকে তীব্র গন্ধ বের হওয়ায় সেটি পরীক্ষা করা হয় এবং দেখা যায়, সেটি কীটনাশক জাতীয় বিষের বোতল।

তৎক্ষণাৎ ফিরোজাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয় পাক পরিষ্কারের জন্য। এরপর রাত ১০টার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিষক্রিয়ার কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ভাটারা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এইচ এম শফিকুল রহমান জানান, এই মৃত্যুর ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্য—উপ-পরিদর্শক জামাল হোসেন এবং নারী কনস্টেবল শারমিন ও নাসিমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে হেফাজতে আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে ভাটারা থানায় আরেকটি পৃথক মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় ওই দুই তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে, বিষটি ফিরোজা অনলাইনের মাধ্যমে কুরিয়ার সার্ভিসে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করেছিলেন, এবং তারা কুরিয়ার কোম্পানি থেকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে।

এদিকে, পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজরুল ইসলাম জানান, রিসাত বর্তমানে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ফিরোজার মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেন, “মৃত্যুর আগে ফিরোজা দাবি করেছিলেন যে, রিসাত তাঁর বৈধ স্বামী, কিন্তু রিসাতের পরিবার তা অস্বীকার করেছে। আমরা সম্পর্কের বৈধতা ও পুরো ঘটনার প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখছি।”

ঘটনার পর ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি) কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই ঘটনার জন্য তারা গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে এবং বিষয়টি তদন্তের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে।

এই ঘটনাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের এক জটিল ও সহিংস বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি পুলিশি হেফাজতের নিরাপত্তা, মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার অভাব, নারীর মানসিক স্বাস্থ্য, এবং বিচারের প্রক্রিয়ায় নারীদের অবস্থান সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন এবং শিক্ষামহল এ ঘটনাকে গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং ফিরোজার মৃত্যুর পেছনে দায়ী সব পক্ষের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও পূর্ণাঙ্গ বিচার প্রক্রিয়ার দাবি জানিয়েছে।

মিনহাজ/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে