ঢাকা, রবিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
Sharenews24

বিশেষজ্ঞদের ভয়াবহ সতর্কবার্তা ইসলামী ব্যাংককে নিয়ে

২০২৫ নভেম্বর ১৬ ০৯:১০:৪৯
বিশেষজ্ঞদের ভয়াবহ সতর্কবার্তা ইসলামী ব্যাংককে নিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক: সম্পদ আকারে দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ঋণদাতা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) এখন ব্যালান্সশিটে দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ঘাটতির মুখোমুখি। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮৫,৮৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ২০ বছরের ডেফারাল সুবিধা অনুমোদন করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুনাফা দিয়ে এই ঘাটতি পূরণ প্রায় অসম্ভব। ইসলামী ব্যাংক গত কয়েক বছর ধরে গড়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করেছে। এই লাভের পুরোটা প্রভিশনে ব্যয় করলেও ঘাটতি পূরণে সময় লাগবে ১৪৩ বছর—যা একটি ব্যাংকের স্বাভাবিক ব্যবসায়িক চক্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। এ বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকের সমন্বিত নিট মুনাফা ছিল মাত্র ৯৯.৭৭ কোটি টাকা। এই পারফরম্যান্স বজায় থাকলে বছরে সম্ভাব্য লাভ দাঁড়াবে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা। এই গতিতে ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে লাগবে ৬৪৫ বছর, যা যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অকল্পনীয়।

অত্যন্ত আশাবাদী হিসাব ধরেও—যেখানে ব্যাংকের মুনাফা প্রতিবছর ১৫ শতাংশ যৌগিক হারে বাড়বে—তবুও প্রভিশন ঘাটতি পুষিয়ে উঠতে সময় লাগবে অন্তত ৩৫ বছর। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, বহু বছর ধরে এমন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বাস্তবসম্মত নয়, বিশেষ করে যখন ব্যাংকের অর্ধেকের বেশি বিনিয়োগ এখন শ্রেণিকৃত।

ইসলামী ব্যাংকের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রহীতা এস আলম গ্রুপ থেকে টাকা উদ্ধার করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। ব্যাংকটি ইতোমধ্যে গ্রুপের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে, কিন্তু নিলামে ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না—যা পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে আরও দুর্বল করেছে। ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এস আলম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ৪,৩৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ১৭ টাকা ঋণের বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ১ টাকা।

এস আলম গ্রুপকে দেওয়া ঋণের প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ, সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ নামের লোকসানী একটি আটা কল মাত্র ১৮ কোটি টাকায় কিনে নেওয়ার পর পরের বছরই ইসলামী ব্যাংক ওই প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদন দেয় ৮৫০ কোটি টাকা ঋণ—যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ১,০০০ কোটি টাকারও বেশি। ব্যাংকিং নীতিমালার এই ধরনের লঙ্ঘন এখন আইবিবিএল-এর ঘাটতির অন্যতম কারণ। এদিকে দুদক ব্যাংক থেকে ১০,৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিআইবিএম-এর সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংককে বাঁচানোর দু’টি পথই খোলা—ঋণ পুনরুদ্ধার অথবা নতুন তহবিল সংযোজন। স্পনসরগোষ্ঠীর পক্ষে এত বড় অর্থ জোগান দেওয়া অসম্ভব হওয়ায় তিনি মনে করেন, শেষ পর্যন্ত সরকারের বাজেট থেকে সহায়তা দেওয়াই হবে প্রধান উপায়। অন্যদিকে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এই ঘাটতিকে বহু বছরের অব্যবস্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ এবং দুর্বল তদারকির ফল বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সরকার চাইলে ব্যাংক পুনঃমূলধনীকরণ করতে পারে, তবে অতীত অভিজ্ঞতা তেমন ইতিবাচক নয়।

এদিকে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান স্বীকার করেছেন যে শুধুমাত্র মুনাফা দিয়ে এত বড় ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, ব্যাংক প্রভিশনের প্রয়োজনীয়তা কমাতে এবং শ্রেণিকৃত ঋণ কমানোর দিকে কাজ করছে। এস আলম গ্রুপের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি বিদ্যমান গ্রাহকদের রেটিং করার পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে, যা ভবিষ্যতের প্রভিশন চাহিদায় কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে বলে ব্যাংকের আশা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ২০২৫ সালের জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকের পরিচালন আয়ের ৯০.৯ শতাংশ খরচ হয়ে গেছে পরিচালন ব্যয়ে। ফলে প্রভিশন রাখার মতো অর্থ হাতে থাকে মাত্র ৯ শতাংশ, যা দিয়ে বিশাল ঘাটতি পূরণ দূরে থাক, ন্যূনতম দায় মেটানোও কঠিন।

মাত্র ৯ মাসেই ব্যাংকের প্রভিশনের প্রয়োজন বেড়েছে আরও ১৬,১২৫ কোটি টাকা—যা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। এমন অবস্থায় ব্যাংকটির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—২০ বছরের ডেফারাল সুবিধা থাকলেও, এস আলম গ্রুপের ঋণ পুনরুদ্ধার ছাড়া ইসলামী ব্যাংকের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর বাস্তব সুযোগ আদৌ আছে কি না।

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে