ঢাকা, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
Sharenews24

৫৪ বছরের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের লাভ-লোকসানের হিসাব

২০২৫ মে ২৭ ১০:৫৬:২০
৫৪ বছরের বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের লাভ-লোকসানের হিসাব

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যাত্রা শুরু হয় কৌশলগত মৈত্রী ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালের মৈত্রী চুক্তি ছিল সেই পথচলার সূচনা। এরপর থেকে বাণিজ্য, পরিবহন, জ্বালানি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, পানি বণ্টনসহ নানা খাতে দুই দেশের মধ্যে অসংখ্য চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

তবে দীর্ঘ ৫৪ বছরের এই সম্পর্কে ভারসাম্য প্রশ্নে নানা বিতর্ক রয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ, তার সুফল ততটা বাংলাদেশের পক্ষে যায়নি। বরং ভারত পেয়েছে অধিক কৌশলগত সুবিধা ও বাস্তবিক সুবিধা।

স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের জন্য ভারত ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ১৯৭২ সালে প্রথম মৈত্রী ও বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় হয়।

যদিও তখনকার সময়ে সীমান্তে ব্যাপক চোরাচালান এবং ভারসাম্যহীন বাণিজ্যের কারণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হয়।

১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফারাক্কা বাঁধসহ একাধিক ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে এরশাদ আমলে সম্পর্ক তুলনামূলক স্থিতিশীল ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর দুই দেশের সম্পর্ক আবার নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।

বাণিজ্য ও সহযোগিতার টাইমলাইন (১৯৭২–২০২৫)

১৯৭২–১৯৮০: সম্পর্কের ভিত্তি গড়া

মৈত্রী চুক্তি (১৯ মার্চ ১৯৭২): ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা।

প্রথম বাণিজ্য চুক্তি (২৮ মার্চ ১৯৭২): সীমান্ত ১৬ কিমি এলাকায় বাণিজ্য ও ট্রানজিট সুবিধা।

নৌপরিবহন চুক্তি (১ নভেম্বর ১৯৭২): ভারত পায় বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ নদীপথ ব্যবহারের অধিকার।

টিপিএ ও রুপিভিত্তিক বাণিজ্য বাতিল (৩০ সেপ্টেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪): রুপির বদলে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু।

১৯৮০–২০০০: সীমিত অগ্রগতি

বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন (১৯৮০, ১৯৮৩)

সাপটা চুক্তি (১৯৯৩): দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যের উদ্যোগ।

২০০০–২০২৫: ঘনিষ্ঠতা ও অসমতা

সাফটা কার্যকর (২০০৬)

ডিএফটিপি স্কিম (২০০৮): এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ পায় ৯৮.২% পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা।

শেখ হাসিনার ভারত সফর (২০১০): ট্রানজিট, বিদ্যুৎ আমদানি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, ভারতকে বন্দর ব্যবহারের অনুমতি।

তিস্তা চুক্তি আটকে যায় (২০১১): পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে চুক্তি হয়নি।

নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর (২০১৫): স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, উপকূলীয় শিপিং, বন্দর ব্যবহারের সুবিধা।

আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি (২০১৭): উচ্চমূল্যের সমালোচিত চুক্তি।

ডিজেল পাইপলাইন (২০২৩): ভারত থেকে সরাসরি ডিজেল আসছে উত্তরাঞ্চলে।

সাম্প্রতিক টানাপোড়েন (২০২৫)

৮ এপ্রিল: ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে।

১৫ এপ্রিল: বাংলাদেশ স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির অনুমতি প্রত্যাহার করে।

১৭ মে: ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে।

এতে পোশাক, খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক ও আসবাবের মতো রপ্তানির মূল খাতগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলোতেই ভারত বাস্তবিক সুবিধা পেয়েছে। যেমন:

বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে সংযোগ।

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অধিকার।

ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও ডিজেল পাইপলাইন সুবিধা।

রেল, সড়ক ও নৌপথ ব্যবহার।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি ও উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ বিক্রির সুবিধা।

বাংলাদেশ কী পেয়েছে?

সীমিত শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা (তাও মাঝে মাঝে স্থগিত)।

কিছু লাইন অব ক্রেডিট (যার শর্ত জটিল ও ভারতমুখী)।

সীমান্ত হাট, শিক্ষাবিনিময় ও সংস্কৃতি খাতে কিছু সমঝোতা।

অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি (বাস্তবায়নে ভারতীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়)।

তিস্তা চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজও ঝুলে আছে।

৫৪ বছরের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভারত কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি সুবিধা নিয়েছে। আর বাংলাদেশ এখনও অপেক্ষায় রয়েছে প্রতিশ্রুত প্রতিদান ও ন্যায্য সুযোগের। সাম্প্রতিক সীমাবদ্ধতা ও টানাপোড়েন যদি অব্যাহত থাকে, তবে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।

মুয়াজ/

পাঠকের মতামত:

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ খবর

আন্তর্জাতিক - এর সব খবর



রে