ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫
Sharenews24

আইসিবি’র সহযোগিতায় শেয়ারবাজারের সরকারি কোম্পানি দখল

২০২৪ সেপ্টেম্বর ১৯ ০৬:৩৪:২৩
আইসিবি’র সহযোগিতায় শেয়ারবাজারের সরকারি কোম্পানি দখল

নিজস্ব প্রতিবেদক: মাফিয়া ডন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত জালিয়াতি করে দখল করেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেড। আর এই দখল বাণিজ্যে সহায়তা করেছে আরেক রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

সরকারকে না জানিয়ে অতি গোপনে বিতর্কিত ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাতের কাছে কম দামে এই কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেয়। এক্ষেত্রে আইনকানুন কোনো কিছুর তোয়াক্কা করা হয়নি। আর এই শেয়ার দিয়েই কোম্পানিটি দখলে নেন নাফিজ সরাফাত ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন। এরপর প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করে সরকারি শেয়ার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়।

এছাড়াও শেয়ার বিক্রি করা হয় আরেক চা কোম্পানি ‘ফিনলে টি’র পরিচালকের কাছে। ওই পরিচালককে আবার কোম্পানির পর্ষদেও নিয়ে আসা হয়। এরপর সব পক্ষ মিলে প্রতিষ্ঠা করা হয় কোম্পানিটিতে দানবীয় আধিপত্য। ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) জোরপূবর্ক পদত্যাগে বাধ্য করে বেপরোয়া দুর্নীতি, কাঁচা পাতা অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি এবং একেকজন আলাদা বাগানগুলো দখল করে নেয়। যুক্ত করা হয় শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার নাতি পরিচয় দেওয়া রংপুরের ব্যবসায়ী সালমান তালিবকে।

শেয়ারবাজারের সম্ভাবনাময় এই কোম্পানিটি ৫ বছরে ২২৩ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির বর্তমান ব্যাংক ঋণ ৩৩৫ কোটি টাকা। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড দিতে না পারায় শেয়ারবাজারে জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। তবে আইসিবির দাবি, তারা আইন মেনেই সবকিছু করেছে। নিয়মানুসারে সরকারি মালিকানাধীন কোনো কোম্পানিতে সরকারের কমপক্ষে ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হয়। বাকি সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি খাতে ছাড়তে পারে। কিন্তু বর্তমানে এনটিসিতে সরকারের শেয়ার মাত্র ২৭.৪৩ শতাংশ। বাকি ৭২.৫৭ শতাংশ বেসরকারি খাতে। অর্থাৎ সরকারি কোম্পানির পুরো নিয়ন্ত্রণ বেসরকারি খাতে।

আবার সরকারি অংশে থাকা ২৭.৪৩ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে আইসিবির হাতে ১১.৫৯ শতাংশ, সাধারণ বীমা করপোরেশন ১১.৫০ এবং সরকারের দুই মন্ত্রণালয় ৪.৩৪ শতাংশ।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতে থাকা ৭২.৫৭ শতাংশ শেয়ারের মধ্যে ১৫.৩৩ শতাংশ শেয়ার আরেকটি চা কোম্পানি ‘ফিনলে টি’র উদ্যোক্তাদের দেওয়া হয়েছে। তাদের আবার পরিচালনা পর্ষদেও রাখা হয়েছে। এভাবে সম্মিলিতভাবে সরকারি একটি কোম্পানি লুটপাট হয়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এনটিসি। কিন্তু বর্তমানে কোম্পানিটি দেউলিয়া। জালিয়াতির মাধ্যমে দখলের পর গত কয়েক বছরে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করা হয়নি। এর মধ্যে মেশিন বিক্রি করে দেওয়া, শ্রমিকদের বেতন না দেওয়া, অবৈধ প্লেসমেন্ট বিক্রি, এমডিকে জোরপূবর্ক পদত্যাগে বাধ্য করা, অবৈধ চা বিক্রি এবং কেনাকাটায় ব্যাপক লুটপাট করা হয়।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবিরকে সামনে রেখে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত দানবীয় এই লুটপাট করেছেন। শেখ কবিরসহ গোপালগঞ্জের ৬ জন পরিচালককে কোম্পানিতে জড়ো করে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। নাফিজ সরাফাত নিজেও শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। তাদের কারণে সরকারি পরিচালকরাও অসহায় ছিলেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুরুতে ‘ন্যাশনাল টি’-তে আইসিবির শেয়ার ছিল ২৯ শতাংশ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকারকে না জানিয়ে গোপনে ধাপে ধাপে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে ১১.৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা এড়াতে আইসিবি প্রতারণার আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে আইসিবি ইউনিট ফান্ডের কাছে থাকা ১৫.৬৬ শতাংশ শেয়ারও সরকারি শেয়ার হিসাবে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে যৌক্তিক নয়। এই শেয়ারের মালিক ও সুবিধাভোগী মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটধারীরা। এখানে মূল আইসিবির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আবার এই ১৫ শতাংশ মিলিয়েও সরকারি শেয়ার হয় ৪৩.০৯ শতাংশ। বিপরীতে বেসরকারি শেয়ারের পরিমাণ বেশি।

এনটিসির মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অনুসারে উদ্যোক্তা শেয়ার বিক্রি করতে হলে আইসিবিকে প্রথমে সরকার এবং সাধারণ বীমা করপোরেশনকে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে কেনার সুযোগ দিতে হবে। তারা অনীহা প্রকাশ করলে স্টক এক্সচেঞ্জের লিস্টিং রেগুলেশন অনুসারে ৩০ কর্মদিবস আগে ঘোষণা দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রির বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো কিছুই মানা হয়নি। ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর নাফিজ সরাফাতের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স সফটওয়্যারের কাছে এনটিসিরি ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬০০ শেয়ার বিক্রি করে আইসিবি। একই মালিকের আরেক কোম্পানি ডাইনেস্টি হোমস ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৭ শেয়ার কেনে। ফলে নাফিসের কাছে কোম্পানিটির মোট শেয়ার দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ১১৭টি। শতকরা হিসাবে যা ৪ শতাংশ।

বিদ্যমান আইন অনুসারে কোনো কোম্পানির পরিচালক হওয়ার জন্য ওই কোম্পানির মোট শেয়ারের ২ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। সে হিসাবে ৪ শতাংশ শেয়ার দিয়ে দুইজন পরিচালক পর্ষদে আসতে পারেন। এই শেয়ারের মাধ্যমে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কোম্পানির ৪৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় ফিনিক্স সফটওয়্যারের পক্ষে নাফিজ সরাফাত পরিচালক হন। ২০২১-২০২২ সালে কোম্পানির ৪৪তম বার্ষিক সাধারণ সভায় ডাইনেস্টি হোমসের পক্ষে পরিচালক নির্বাচিত হন নাফিজ সরাফাতের অফিসের কর্মকর্তা আতিফ খালেদ।

গত ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নাফিজ সরাফাতের ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়। কিন্তু আতিফ খালেদের অ্যাকাউন্টগুলো স্থগিত করা হয়নি। এক্ষেত্রে একজন শেয়ারহোল্ডার কোম্পানিকে লিখিত নোটিশ দেন। এই নোটিশ বিএসইসির চেয়ারম্যানের কাছেও পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, আইসিবির সহযোগিতায় নাফিজচক্রের কারসাজির কারণে ৮০০ টাকার শেয়ার ২৬০ টাকায় নেমে আসে। এতে ব্যাপক লোকসানে পড়েন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। তারা কয়েকজন মিলে কোম্পানির দামি বাগানগুলো ভাগ করে নেন।

এদিকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বর্তমানে এনটিসির মোট শেয়ারের মধ্যে শাকিল রিজভীর কাছে ২.৩০ শতাংশ, আইসিবি ১১.৫৯ শতাংশ, আইসিবি ইউনিট ফান্ডে ১৫.৬৬ শতাংশ, ফিনলে টির পরিচালক শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে মো. জারান আলী চৌধুরীর কাছে ৫.৪৮ শতাংশ, ফিনলে টির আরেকজন পরিচালক রামগর চা বাগানের মালিক নাদের খানের কাছে ৯.৮৪ শতাংশ, মো. সরওয়ার কামাল ২.১১ শতাংশ, ইক্যুইটি রিসোর্স ৫.৭৮ শতাংশ, সাধারণ বীমা করপোরেশন ১১.৪৯ শতাংশ, ফিনিক্স সফটওয়্যার ২.১০ শতাংশ এবং ডাইনেস্টি হোমসের কাছে ২.০৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।

এদিকে সরকারের শেয়ার কমে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে ন্যাশনাল টি কোম্পানি। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরামর্শে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর কোম্পানির অতিরিক্ত সভায় কোম্পানির ২ কোটি ৩৪ লাখ প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ১০ টাকার প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে ১০৯.৫৩ পয়সা প্রিমিয়ামসহ ইস্যুমূল্য নির্ধারণ করা হয় ১১৯.৫৩ টাকা। অর্থাৎ ২৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হবে। এতে পরিশোধিত মূলধনে যোগ হবে ২৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

তবে এখানেও রয়েছে বিশাল বৈষম্য। কারণ, মোট শেয়ারের ৪০.৭৬ শতাংশ অর্থাৎ ৯৫ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪টি শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য। বাকি ৫৯.২৪ শতাংশ বা ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার ৯৪৬টি শেয়ার পরিচালকদের দেওয়া হয়। অর্থাৎ উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার গোপনে বিক্রি করে বেসরকারি লোকজনকে বোর্ডে আনা হয়। এরপর প্লেসমেন্টের মাধ্যমে নতুন শেয়ার ইস্যু করে উদ্যোক্তা শেয়ার বাড়ানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি ভয়াবহ জালিয়াতি।

প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়েও নাফিজ সরাফাত তৈরি করেন অনৈতিক বাণিজ্য। প্লেসমেন্টের টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব পায় নাফিজ সরাফাতের মালিকানাধীন পদ্মা ব্যাংক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি। ১৫ সেপ্টেম্বর টাকা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল। এটি বাড়ানোর জন্য বিএসইসিতে আবেদন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা ব্যাংক রুগ্ণ। এই ব্যাংকে টাকা গেলে আর ফেরত আসার কথা নয়।

অন্যদিকে, কোম্পানির বাণিজ্য বিভাগেও চলছে লুটপাট। সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে প্রতি কেজি চা ১৬০ টাকার কমে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু ওই নিয়ম ভঙ্গ করে প্রতি কেজি ১ ডলারে ভারতের এক ব্যবসায়ীর কাছে এক লাখ কেজি চা বিক্রি করা হয়েছে। এতে কোম্পানির ১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসাব করলে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি ১৫ লাখ টাকা।

এএসএম/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে