ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

২৫ বছর যাবত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম!

২০২৪ আগস্ট ১৮ ১৯:২৫:৪৯
২৫ বছর যাবত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম!

নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসাবে ২৫ বছর যাবত রয়েছেন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। তার একক সিদ্ধান্তে রীতিনীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রবিধান উপেক্ষা করে পরিচালিত হচ্ছে শরিয়াহভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। তিনি পারিবারিক সম্পত্তির মতো ভোগ করছেন ব্যাংকটির সম্পদ।

ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কোম্পানি সচিব, মানবসম্পদ বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগের প্রধান পদে বসিয়েছেন তার আত্মীয়স্বজনদের। টানা চেয়ারম্যান পদে তাকে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আকুন্ঠ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। কাজী আকরাম এবং কয়েকজন উদ্যোক্তা যাতে সারা জীবন তাদের পদে থাকতে পারেন, সেজন্য বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন।

১৯৯৯ সালের ১১ মে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ২০২০ সালে ব্যাংকটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক হিসেবে সরকারের অনুমোদন পায়। কাজী আকরাম ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকটির পরিচালনায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যানও তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই দাবি করতেন নিজেকে।

সেই সুবাধে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে কাজী আকরাম নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে। ব্যাংকে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পর্ষদ সভায় প্রস্তাব তোলা হলেও পরিচালকদের মতামত উপেক্ষা করেই সবকিছু পার করে নিতেন তিনি। এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাছে বিস্তর অভিযোগ দিয়েছেন ব্যাংকটির কয়েকজন শাখা ব্যবস্থাপক। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

কাজী আকরামের গাড়ি বিলাস

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজের ব্যবহারের জন্য ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকায় একটি ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো কিনেছেন কাজী আকরাম। ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৬০ সিসির গাড়িটি কেনা হয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গ্রাহক নারায়ণগঞ্জের চৈতী গার্মেন্টেসের মালিক আবুল কালামের নামে। ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৬৯৬৯ নম্বরের গাড়িটি প্রতি মাসে ৫ লাখ টাকা দিয়ে আবুল কালামের কাছ থেকে ভাড়া নেয় ব্যাংক। ভাড়া গাড়ি ব্যবহার করে ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হওয়ায় আপত্তি তোলে বাংলাদেশ ব্যাংক গাড়ি কেনার নির্দেশ দেয়।

পরে আবুল কালামের কাছ থেকে গাড়িটি ১ কোটি টাকায় কিনে নেয় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। বাকি প্রায় আড়াই কোটি টাকাও ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়েছে এবং সেটা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অগোচরে। ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জারি করা সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে চেয়ারম্যানের জন্য সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকায় একটি গাড়ি কেনা যাবে। চেয়ারম্যানের ব্যবহৃত পুরনো নিশান প্যাট্রল জিপটিও নিজের নামে লিখে নিয়েছেন কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ। ব্যাংকের নামে থাকা ঢাকা মেট্রো ঘ-১১-৮৪৭৮ নম্বরের জিপটি ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিআরটিএর মিরপুর অফিস থেকে মালিকানা হস্তান্তর করে নিজের নামে লিখে নেন কাজী আকরাম।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের এমপি হওয়ার পর মেয়ে বেদৌরা আহমেদ সালামের নামে পাঁচ সিটের চট্ট-মেট্রো গ-১১-৬৯১৭ নম্বরের ২৬০০ সিসির টয়েটা প্রিমিও গাড়িটি লিখে দিয়েছেন নামমাত্র মূল্যে। বিধি মোতাবেক ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করার জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা তৃতীয়পক্ষ হলেও তার কাছে বিক্রি করার কথা।

২৫ বছর যাবত চেয়ারম্যান

১৯৯৯ সালের ১১ মে যাত্রা শুরুর ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী আকরাম। ২০১৮ সালে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের দুজনের পদ বাড়িয়ে চারজন করা হয়। তখন একই পরিবারের চারজন সদস্য পরিচালক নিযুক্ত হতে পারতেন। তাদের মেয়াদও বাড়িয়ে ৯ বছর করা হয়। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টানা ২৫ বছর চেয়ারম্যানের পদে আছেন কাজী আকরাম।

ব্যাংকের টাকায় ব্যক্তিগত চার অফিস

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের জন্য একটি অফিস কক্ষ, একজন ব্যক্তিগত সহকারী, একজন পিয়ন, অফিসে একটি টেলিফোন, দেশে ব্যবহারের জন্য একটি মোবাইল, একটি গাড়ি থাকার কথা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে কাজী আকরাম রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরের শেজাদ প্যালেসের তিনতলায় ব্যবহার করেন ৪ হাজার ২০০ স্কয়ার ফুটের একটি অফিস। তার অফিসের নিচেই রয়েছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের শাখা। সেখানে গিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকের ওপরে চেয়ারম্যানের অফিস রয়েছে, যাওয়া যাবে না। এ ছাড়া কাজী আকরামের ব্যবহারের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখার ওপরে একটি, চট্টগ্রামে একটি ও প্রধান কার্যালয়েও অফিস আছে।

ছেলের ৮১ বছর বয়সী শ্বশুর ১৩ বছর স্বতন্ত্র পরিচালক

কাজী আকরাম তার হাত শক্তি শালী করার জন্য তার ছেলে কাজী খুররম আহমেদের শ্বশুর নাজমুল হক চৌধুরীকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করেছেন। তিনি গত ১১ বছর যাবত ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক। ২০১৮ সালে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ব্যাংক কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক পদে একাদিক্রমে দুই মেয়াদে ছয় বছরে বেশি সময় থাকতে পারবেন না। আইনের ব্যত্যয় ঘটলেও প্রভাব খাটিয়ে নিজের বেয়াইকে ১১ বছর ধরে পরিচালক পদে বহাল রেখেছেন কাজী আকরাম।

শুধু তাই নয়, পরিচালকের সর্বোচ্চ বয়স হতে পারে ৭৫ বছর। কিন্তু নাজমুল হক চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৯ জানুয়ারি, সে হিসাবে তার বয়স ৮১ বছর। পরিচালকের প্রাপ্ত সুবিধার বাইরেও বেয়াইকে চট্টগ্রাম থেকে বিমানে ঢাকায় আসা-যাওয়া, পাঁচতারকা হোটেলে থাকা-খাওয়ার খরচও ব্যাংক বহন করত। নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্যই ছেলের শ্বশুরকে স্বতন্ত্র পরিচালক বানিয়েছেন কাজী আকরাম।

লোকসানের পরও লস অ্যাঞ্জেলেস শাখা চালু

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একটি শাখা রয়েছে। শাখাটি পরিচালনায় মাসে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লোকসান হয। তারপরও চালু রাখা হয়েছে শুধু স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভা করার জন্য। মাঝেমধ্যে কাজী আকরামও সেখানে সভা-সমাবেশ করতেন। ওই শাখার ম্যানেজার শাহ আলম চৌধুরী ২০১৪ সাল থেকে প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি সেখান থেকেও বেতন-ভাতা নিচ্ছেন।

ডেপুটেশনে থাকা কোনো কর্মকর্তা দ্বিগুণ বেতন না পেলেও চেয়ারম্যানের ইচ্ছায় শাহ আলমকে তা দেওয়া হচ্ছে। বছরে তিন-চারবার কাজী আকরাম ও তার ছেলে ব্যাংকের পরিচালক কাজী খুররম যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন ব্যাংকের খরচে। গভর্নরকে দেওয়া অভিযোগে এসব উঠে এসেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এক্সচেঞ্জ হাউজ প্রকৃতপক্ষে লোকসানে থাকলেও প্রতি বছর মুনাফা করে বলে দেখানো হয়।

মিজান/

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে