ঢাকা, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

লাভেলোর ‘অলৌকিক’ মুনাফা: বিনিয়োগকারীদের আস্থা তলানিতে

২০২৫ অক্টোবর ১৩ ২১:১৭:৪৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: আর্থিক স্বচ্ছতা ও শেয়ার কারসাজির অভিযোগে বহুবার আলোচনায় আসা লাভেলো আইসক্রীম আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে। এবারও কোম্পানিটি ‘রেকর্ড মুনাফা’ দেখালেও বিনিয়োগকারীরা সেটিকে সাফল্য নয়, বরং কারসাজির ইঙ্গিত হিসেবেই দেখছেন।

২০২৫ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটি ১৬ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে—এর মধ্যে ১১ শতাংশ ক্যাশ ও ৫ শতাংশ বোনাস। আগের বছর এই হার ছিল ২০ শতাংশ (১০% ক্যাশ ও ১০% বোনাস)। কিন্তু মুনাফার হিসাব নিয়ে বাজারে এখন তুমুল প্রশ্ন।

তৃতীয় প্রান্তিকে ধস, চতুর্থ প্রান্তিকে স্থবিরতা—হঠাৎ উল্লম্ফনেই সন্দেহ

লাভেলোর আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির ইপিএস কমে দাঁড়ায় মাত্র ২২ পয়সায়—যেখানে আগের বছর একই সময়ে ছিল ৭১ পয়সা। চতুর্থ প্রান্তিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়; পুরো বছরের ইপিএস হয় মাত্র ১ টাকা ৬৫ পয়সা, অর্থাৎ শেষ প্রান্তিকে আয় হয়েছে মাত্র ৬ পয়সা।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে নতুন অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই (জুলাই–সেপ্টেম্বর) কোম্পানিটি মাত্র ১১ দিনের মাথায় রিপোর্ট প্রকাশ করে দেখিয়েছে ইপিএস ১ টাকা ২ পয়সা—যা আগের দুই প্রান্তিকের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে: “একই ব্যবসা, একই বাজার, একই পরিবেশ—তবুও হঠাৎ এমন মুনাফা কীভাবে সম্ভব?”

বিএসইসি তদন্তাধীন, কারসাজির ছায়া আরও গাঢ়

এরই মধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লাভেলো-সম্পৃক্ত তিনটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের বিক্রয় কার্যক্রম ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছে। অভিযোগ—এই অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করেই কোম্পানির শেয়ারের দর কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়েছিল।

বিএসইসির হস্তক্ষেপের পর বাজারে লাভেলোকে ঘিরে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। যার ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনীহা ক্রমাগত বাড়ছে।

আবদুর রহমান নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘এক সময়ে লাভেলোর শেয়ারে আমি সক্রিয় ছিলাম। কোম্পানিটির প্রতি আমার দুর্বলতাও ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম কোম্পানির মালিকরাই শেয়ারটি নিয়ে কারসাজিতে লিপ্ত, যখণ যেমন প্রয়োজন, তখন তেমন মুনাফা প্রকাশ করে, তখন থেকে কোম্পানিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।’

আবদুস সামাদ নামের আরেক বিনিয়োগকারী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই কোম্পানির মালিক নিজেই শেয়ারবাজারে কারসাজিকারীদের সাথে অবাধে মেলামেশা করেন। এমন শেয়ারে বিনিয়োগ করা মানে জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনা। এই স্টকের দিকে ভুলেও আর তাকানো যাবে না—একবার ঠকে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।’

আর্থিক গরমিল ও ‘রিস্টেটেড’ হিসাবের প্রশ্ন

সম্প্রতি কোম্পানিটি আগের বছরের (২০২৪) আর্থিক প্রতিবেদন রিস্টেট বা সংশোধন করেছে। যেখানে নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) কমে এসেছে ১১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা থেকে ১০৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকায়। অর্থাৎ, আগের প্রতিবেদনে কোম্পানিটি সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে দেখিয়েছিল—যা হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ জাগিয়েছে।

বাজারে আস্থাহীনতা চরমে

ডিভিডেন্ড ঘোষণার আগের দিন লাভেলোর শেয়ারের ক্লোজিং প্রাইস ছিল ৯৭ টাকা ৩০ পয়সা। ডিভিডেন্ড ঘোষণার দিন রোববার (১২ অক্টোবর) দাম কমে ৯৪ টাকা ৯০ পয়সায় নামে—অর্থাৎ ২ টাকা ৪০ পয়সা পতন। আজ সোমবার চাঙ্গা বাজারে দর আরও কমেছে ৭০ পয়সা, ক্লোজিং হয়েছে ৯৪ টাকা ২০ পয়সায়।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ডিভিডেন্ড ঘোষণার পর মালিক ও কারসাজিকারীদের নামে-বেনামে যে শেয়ার ছিল, সেগুলো বিক্রি চলছে। যে কারণে আজ চাঙ্গা বাজারেও শেয়ারটি পতন প্রবণতায় ছিল। এই ব্যাপক বিক্রয়চাপের কারণে শেয়ারটির দর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি এবং এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, “অস্বাভাবিক ইপিএস বৃদ্ধি, প্রতিবেদন রিস্টেট, বিএসইসির তদন্ত—সবকিছু মিলিয়ে কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে।”

২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর থেকে লাভেলো কখনোই প্রান্তিকভিত্তিক ১ টাকার ওপরে ধারাবাহিক ইপিএস দেখাতে পারেনি। অথচ এবার প্রথম প্রান্তিকে রেকর্ড মুনাফা দেখিয়েছে—যা অনেকের চোখে ‘সাফল্য’ নয়, বরং ‘সন্দেহ’ হিসাবে দেখা দিয়েছে।

এসএম/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে