ঢাকা, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Sharenews24

ভলিউম লিডারে আকাশছোঁয়া পিইর দুই শেয়ার

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১২ ২১:৪৭:৫১
ভলিউম লিডারে আকাশছোঁয়া পিইর দুই শেয়ার

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের নজর কেড়েছে দুই শেয়ার—খান ব্রাদার্স ও ওরিয়ন ইনফিউশন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি এবং আকাশছোঁয়া প্রাইস-আর্নিংস (পিই) রেশিওর কারণে শেয়ার দুটি আলোচনায় এসেছে। এরই মধ্যে সাপ্তাহিক ভলিউম লিডারের শীর্ষ স্থানে জায়গা করে নিয়েছে এই দুই শেয়ার। তবে বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই উত্থান মূলত কারসাজির ফল, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।

অস্বাভাবিক পিই রেশিও

খান ব্রাদার্সের সর্বশেষ শেয়ার দর দাঁড়িয়েছে ১৫৩ টাকা এবং এর পিই রেশিও ৭৬৫—যা বাজারে স্বাভাবিক ধারা থেকে অনেক দূরে। অন্যদিকে ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার দর ৫০৯ টাকা ৪০ পয়সা হলেও এর পিই রেশিও ২৭২.৮৯, যা আয়ের তুলনায় একেবারেই অস্বাভাবিক। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত উচ্চ পিই রেশিও বিনিয়োগকারীদের জন্য সতর্ক সংকেত, কারণ তা শেয়ারের প্রকৃত মুনাফার সাথে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দ্রুত উঠানাম: স্বাভাবিক না কারসাজি?

গত সপ্তাহে খান ব্রাদার্সের শেয়ার দর বেড়েছে ১০.৩৯ শতাংশ এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার কমেছে ১০.৮৮ শতাংশ। অথচ ৭ জুলাই খান ব্রাদার্সের শেয়ার ছিল মাত্র ১০৮ টাকা এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের শেয়ার ছিল ৩০৬ টাকা। অল্প সময়ের ব্যবধানে শেয়ার দুটির দাম বেড়েছে খান ব্রাদার্সের ৪১.৬৫ শতাংশ এবং ওরিয়ন ইনফিউশনের ৬৬.৪৭ শতাংশ। শেয়ার দামে এমন উত্থান বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, একই গ্রুপের ব্যবসায়ীরা শেয়ার দুটি নিয়ে পরিকল্পিতভাবে কারসাজি করছেন। যা বিএসইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাকের ডগায় চলছে।

খান ব্রাদার্স: আয় ও ডিভিডেন্ড তলানিতে

খান ব্রাদার্সের পরিশোধিত মূলধন ৯৮ কোটি ০৮ লাখ টাকা এবং রিজার্ভ মাত্র ১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ডিভিডেন্ড ইতিহাসে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের খুবই হতাশ করেছে। ২০২৪ সালে দিয়েছে মাত্র ১% ক্যাশ ডিভিডেন্ড, ২০২৩ ও ২০২১ সালে কোনো ডিভিডেন্ডই দেয়নি, আর ২০২২ ও ২০২০ সালে দিয়েছে সর্বোচ্চ ২% ক্যাশ ডিভিডেন্ড।

একই সময়ে কোম্পানির আয়ও ছিল প্রায় তলানিতে। শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ২০২৪ সালে হয়েছে মাত্র ০১ পয়সা। এর আগের বছরগুলোতে লোকসান ছিল নিয়মিত—২০২৩ সালে ০৬ পয়সা, ২০২২ সালে ১৮ পয়সা, ২০২১ সালে ১৫ পয়সা এবং ২০২০ সালে ০৯ পয়সা।

সম্পদ মূল্যের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ২০২৪ সালে শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৮৮ পয়সা, যা প্রায় একই রকম ছিল গত পাঁচ বছর ধরে (২০২৩ সালে ১১.৮৭ টাকা, ২০২২ সালে ১১.৯৪ টাকা, ২০২১ সালে ১২.২৬ টাকা এবং ২০২০ সালে ১১.৫৫ টাকা)। অর্থাৎ, কোম্পানির আর্থিক চিত্র মোটেই ইতিবাচক নয়।

কোম্পানিটি সম্প্রতি এক চটকদারি ঘোষণা দিয়ে বলেছে যে—স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য এখন তাদের নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন শুরু করবে। যেটি শুনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রথমে খুশির ছাপ লাগে; ধরা হয়েছিল, অবশেষে কোম্পানি কার্যক্রমে নতুন ভাঁজ খুলছে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আলাদা—এতদিন কোম্পানিটি নিজস্ব পণ্য উৎপাদনই করেনি এবং সেই মৌলিক তথ্যটি বাজারে গোপন রাখা হয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে এটি কোনো নতুন সংবাদ না; দীর্ঘদিন ধরে কোম্পানিটি অন্য এক প্রতিষ্ঠানের পণ্য সাব-কনট্রাক্ট করে কোনভাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ‘স্বকীয় উৎপাদন’ নামে যা আজ ঘোষণা করা হচ্ছে, সেটি মূলত শেয়ারদরে প্রভাব ফেলার জন্য আগেভাগে সাজানো কৌশল—এক ধরণের বাজারপ্রবঞ্চনা। বাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের সময় যে কারণে কোম্পানিটি নিজস্ব কারখানায় উৎপাদন করার কথা বলেছিল, সেটি বাস্তবে করেনি এবং বিনিয়োগকারীদের জানানোও হয়নি—এতে স্পষ্ট আইনের লংঘন ও প্রতারণার শামিল।

এমন গোপনীয়তা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যপ্রচারণা শেয়ারধারীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছুই নয়। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি শুধু নৈতিক বিচ্যুতি নয়—বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীর টাকাকে ভন্ডুল করে রাখা এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি বদলে বাজারে চটকদারি ঘোষণা দিয়ে মূল্য বাড়ানো-যা স্বচ্ছ তদন্তের দাবি তোলে। তাদের দাবি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্ত করে উন্মোচন করা দরকার, কিভাবে এবং কেন বিনিয়োগকারীদের কাছে সত্যিকারের ব্যবসায়িক পরিস্থিতি লুকিয়েছিল।

বাজার সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এই ধরনের অন্যায়মূলক আচরণ যদি অপরিণত থেকে যায়, তবে ভবিষ্যতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর বিশ্বাসভঙ্গ এবং শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীলতা গুণতে হবে—তাই দোষীদের দ্রুত আইনি ও নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ করা হওয়া উচিত।

ওরিয়ন ইনফিউশন: মুনাফা থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ

ওরিয়ন ইনফিউশনের পরিশোধিত মূলধন ২০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা এবং রিজার্ভ ১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। কোম্পানিটি নিয়মিত ডিভিডেন্ড দিয়ে আসছে—২০২৪ সালে ১২ শতাংশ, ২০২৩ সালে ১০ শতাংশ, ২০২২ সালে ২০ শতাংশ, ২০২১ সালে ১০ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে। আয়ও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল; গত পাঁচ বছরে ইপিএস ১.৩৭ টাকা থেকে ২.১০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করেছে। সম্পদমূল্যও ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৫ টাকা ৪৫ পয়সায়।

তবে আর্থিক পারফরম্যান্স ইতিবাচক হলেও বাজারে এর বর্তমান পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ারের দর ও পিই রেশিও আয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা মনে করেন, পরিকল্পিত কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধি রোধে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর ভূমিকা জরুরি। না হলে ওরিয়ন ইনফিউশনের মতো শেয়ারে কৃত্রিম উত্থানের সুযোগে প্রভাবশালী মহল লাভবান হবে, আর শেষ পর্যন্ত ক্ষতির বোঝা বইতে হবে ছোট বিনিয়োগকারীদেরই।

এএসএম/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে