ঢাকা, সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

ভারতীয় সুতার আগ্রাসনে ধ্বংসের পথে দেশীয় মিল

২০২৫ ডিসেম্বর ২৯ ২১:২৪:৩৬
ভারতীয় সুতার আগ্রাসনে ধ্বংসের পথে দেশীয় মিল

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের প্রাইমারি টেক্সটাইল সেক্টর বর্তমানে এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। ভারত থেকে আসা সস্তা সুতার বন্যায় দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মিলগুলোতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা মূল্যের সুতা অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। আমদানিকৃত ভারতীয় সুতার কারণে দেশীয় সুতার চাহিদা তলানিতে নামায় এই বিশাল অংকের পণ্য গুদামে পচে মরছে।

গতকাল রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তিনি জানান, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারত থেকে সুতা আমদানির হার অবিশ্বাস্যভাবে ১৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে বাংলাদেশে সুতা সরবরাহ করছে, যাকে ব্যবসায়িক ভাষায় ‘ডাম্পিং’ বলা হয়। দেশীয় মিলগুলো যেখানে প্রতি কেজি সুতা ৩ ডলারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে, সেখানে ভারতীয় সুতা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২.৫০ ডলারে। এই ৫০ সেন্টের ব্যবধানই দেশীয় শিল্পের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিচ্ছে।

বিটিএমএ সভাপতির মতে, এই অসম প্রতিযোগিতার কারণে গত কয়েক বছরে প্রায় ৫০টি স্পিনিং মিল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, তার নিজেরও একটি বড় মিল বন্ধ হয়ে গেছে এবং অন্যটি কোনোমতে টিকে আছে। প্রতিটি মিলে গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ থাকে। একবার একটি মিল বন্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় চালু করা পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি সতর্ক করে বলেন, ভারতের ওপর সুতার জন্য অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। অতীতে ভারত কোনো ঘোষণা ছাড়াই তুলা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলেছিল। একই ঘটনা সুতার ক্ষেত্রে ঘটলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মুখ থুবড়ে পড়বে।

সংবাদ সম্মেলনে সাবেক বিটিএমএ পরিচালক রাজীব হায়দার এই পরিস্থিতিকে ‘অর্থনৈতিক আগ্রাসন’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখান যে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের সুতা আমদানি করা হয়েছে। বর্তমানে ভারতের মোট সুতা রপ্তানির ৪৪ শতাংশই বাংলাদেশে আসছে, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক পোশাক ব্র্যান্ডগুলোও উৎপাদন খরচ কমাতে এখন দেশীয় সুতার বদলে ভারতীয় সুতা ব্যবহারের জন্য চাপ দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী ভারতীয় সুতার কম দামের রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ভারত সরকার তুলা চাষি থেকে শুরু করে কারখানা এবং রপ্তানি পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়। ফলে তাদের উৎপাদন খরচ অনেক কম হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মিল মালিকদের চড়া সুদে ঋণ নিতে হয় এবং কাঁচামাল আমদানিতেও নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। অপর এক সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, এভাবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের স্বাধীনতাও খর্ব হবে।

এই সংকটকালীন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিটিএমএ আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরকারের কাছ থেকে নীতি সহায়তার দাবি জানিয়েছে। তাদের প্রধান সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে:

দেশীয় সুতা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানি করলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রদান।

রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (EDF) সীমা বৃদ্ধি এবং সুদের হার কমানো।

ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনা।

যেসব সুতা দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত হয়, সেগুলো আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

মিল মালিকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সম্বলিত এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যাবে, যার ফলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন।

এমজে/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে