ঢাকা, রবিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৫
Sharenews24

রেনাটা–ইফাদ অটোস: দুই শেয়ারে আইসিবির লোকসান ৭০০ কোটি

২০২৫ নভেম্বর ২৩ ১৬:১৯:২৮
রেনাটা–ইফাদ অটোস: দুই শেয়ারে আইসিবির লোকসান ৭০০ কোটি

নিজস্ব প্রতিবেদক : একসময় ধারাবাহিক মুনাফায় পরিচালিত রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন (আইসিবি) এখন গভীর সংকটে নিমজ্জিত। অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, উচ্চমূল্যে শেয়ার ক্রয় এবং শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক ধস প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তিকে কার্যত নড়বড়ে করে দিয়েছে। ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি রেকর্ড ১,২১৪ কোটি টাকা লোকসান করে; চলতি ২০২৫–২৬ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকেও লোকসান দাঁড়িয়েছে আরও ১৫১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার থেকে আইসিবির ইরোশন বা আনরিয়ালাইজড লস দাঁড়িয়েছে ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি।

আইসিবির বোর্ড ও কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, বর্তমান অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা চরম ঝুঁকির মুখে। আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, “স্বাভাবিক অবস্থায় এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অতীতে ব্যাংক থেকে ব্যাপক ঋণ নিয়ে ভেস্টেড গ্রুপের স্বার্থে উচ্চমূল্যে শেয়ার কেনা হয়েছে। এখন এসব শেয়ারের বাজারদর ক্রয়মূল্যের তুলনায় অনেক কম।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, বাজারের কিছু গ্যাম্বলার “পাম্প অ্যান্ড ডাম্প” পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে শেয়ারের ডাম্পিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করেছে।

সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার লঙ্ঘন, ঋণের চাপ চরমে

অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণের কারণে আইসিবি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার সীমা অতিক্রম করেছিল। এ কারণে সোনালী ব্যাংক ৩৭৫ কোটি টাকা ফেরত চাইলে আইসিবি বাধ্য হয়ে শেয়ার বিক্রি করে টাকা শোধ করে। আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নীরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ জানান, উচ্চহারে নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধেই প্রতি মাসে ৯০ কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়, যা লোকসানের অন্যতম প্রধান কারণ। তার ভাষায়, “বিনিয়োগে প্রভিশন বৃদ্ধি, শেয়ারবাজারে ইরোশন এবং ঋণের সুদ ব্যয় বাড়ায় লোকসান হয়েছে।”

পোর্টফোলিওতে ভয়াবহ ক্ষতি: রেনাটা–ইফাদ অটোস বড় উদাহরণ

আইসিবির বৃহৎ ক্ষতির অন্যতম উদাহরণ রেনাটার শেয়ার ক্রয়। প্রতিষ্ঠানটি মোট ৯০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছিল, যার কিছু শেয়ার ক্রয়মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ১,৪৮০ টাকা। বর্তমানে এসব শেয়ারের দাম ৩৮৯ টাকা, ফলে লোকসান দাঁড়িয়েছে ৫২১ কোটি টাকার বেশি।

আরেক বড় ক্ষতি হয়েছে ইফাদ অটোসের শেয়ারে। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ৯৫ টাকা দরে শেয়ার কিনেছিল, মোট ব্যয় ২৬৫ কোটি টাকা। বর্তমানে দাম নেমে এসেছে ১৯ টাকা, যেখানে আইসিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ২১১ কোটি টাকা।

পোর্টফোলিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ইরোশন হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে কেনা শেয়ারগুলিতে। পরে গড় মূল্য কমাতে শেয়ার কেনা হলেও বাজারে ধারাবাহিক পতনের কারণে ক্ষতি কমেনি।

১,০০০ কোটি টাকার বেশি এফডিআর ফেরত পাচ্ছে না

দুর্বল অবস্থার আরেকটি কারণ হলো এফডিআরে বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত না পাওয়া। প্রতিষ্ঠানটি একটি ব্যাংক ও ১০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ৯২০ কোটি টাকার এফডিআর করেছিল, যা সুদসহ এখন ১,০০০ কোটি ছাড়িয়েছে। মেয়াদ শেষ হলেও আইসিবি এই অর্থ ফেরত পায়নি, যা তারল্য সংকটকে আরও তীব্র করেছে।

মুনাফা থেকে লোকসানে—এক দশকে চিত্র উল্টে গেছে

২০০৯–১০ থেকে ২০১৭–১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত টানা নয় বছর আইসিবি গড়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল। কিন্তু ২০১৮–১৯ সালে মুনাফা নেমে আসে মাত্র ৬০ কোটি টাকায়। পরবর্তী ছয় বছর গড়ে মুনাফা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৮১ কোটি। সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি রেকর্ড ১,২১৫ কোটি টাকা লোকসানে পড়ে।

ঋণের পাহাড়: মোট দায় ১৩ হাজার কোটি টাকা

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রেজেন্টেশনে জানানো হয়—২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আইসিবির মোট দায় দাঁড়িয়েছে ১৩,০৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১২,০২৭ কোটি টাকা ঋণ। এ ঋণের ওপর বকেয়া সুদ রয়েছে ১,০০৩ কোটি টাকা। শুধু সুদ পরিশোধেই আইসিবির মোট আয়ের ৯৪ শতাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে।

টিকে থাকতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন

সংকট থেকে উত্তরণে আইসিবি সরকারের কাছে ১৩ হাজার কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩,০০০ কোটি টাকা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি—এর মধ্যে ২,০০০ কোটি ঋণ পরিশোধে এবং ১,০০০ কোটি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে ব্যবহার হয়েছে। এই বিনিয়োগ থেকে মার্চ পর্যন্ত আইসিবির মুনাফা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা।

অভিযোগের তীর কিছু কর্মকর্তার দিকে

আইসিবির বর্তমান সংকটের পেছনে দায়ী করা হচ্ছে অতীতের বোর্ড এবং পোর্টফোলিও বিভাগের কিছু কর্মকর্তাকে। অভিযোগ আছে—তারা বাজারের গ্যাম্বলারদের সঙ্গে যোগসাজশে উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠানটিকে বিপদে ফেলে। বিশেষ করে ২০১৬–২০১৭ সালে পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৎকালীন এজিএম হাবীবুর রহমানের সময় প্রায় ২,৯০০ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছিল, যার বর্তমান মূল্য ১,৩০০ কোটি, অর্থাৎ ইরোশন ১,৬০০ কোটি টাকা।

হাবীবুর রহমান স্বীকার করেছেন, “কিছু কর্মকর্তা ব্যক্তিগত স্বার্থে উচ্চমূল্যে শেয়ার কিনেছেন।” এ বিষয়ে দুদক ইতোমধ্যে তদন্ত করছে।

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে