ঢাকা, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

ঘুষ, নথি ফাঁস, দুর্নীতিতে চরম ভাবমূর্তি সংকটে এনবিআর

২০২৫ অক্টোবর ২৭ ০৮:০০:১৩
ঘুষ, নথি ফাঁস, দুর্নীতিতে চরম ভাবমূর্তি সংকটে এনবিআর

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা যেন একের পর এক বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। গত কয়েক মাসে ঘুষ গ্রহণ থেকে শুরু করে আয়কর নথি হস্তান্তর, রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁস, এমনকি স্বয়ং চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ— কোনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ডই বাকি নেই। প্রায় দেড়শ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগও উঠেছে। প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অস্ট্রেলিয়া সফর কিংবা কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে গালিগালাজের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এই লাগামহীনতা সংস্থাটির ভাবমূর্তিকে মারাত্মক সংকটে ফেলেছে।

বিশৃঙ্খলা ও আন্দোলনের চিত্র:

গত এপ্রিলে এনবিআর বিলুপ্ত করে 'রাজস্ব নীতি' এবং 'রাজস্ব ব্যবস্থাপনা' নামে দুটি বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ জারির পর থেকেই সংস্থাটির অভ্যন্তরে এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। এই অধ্যাদেশ বাতিল ও চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে কর্মকর্তারা 'সিবিএ স্টাইলে' ধর্মঘট, কলম বিরতি, এবং 'মার্চ টু এনবিআর'-এর মতো কর্মসূচি পালন করেন।

• আন্দোলনের সময় কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট কিছু সেবা ছাড়া সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেন, যার ফলে মে ও জুন মাসে বাজেট প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

• এই আন্দোলন চলাকালে কয়েকজন কর্মকর্তার বদলির আদেশ প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলার মতো 'ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও' দেখা যায়, যা তাদের অপেশাদার ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে সংস্থাটির ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে।

বহু 'মতিউর' ও দুর্নীতির নতুন মামলা:

'ছাগলকাণ্ডে' দেশজুড়ে আলোচিত সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কয়েকশ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ও তার স্ত্রী বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারে আছেন।

চলতি অক্টোবরেই এনবিআর-এর আরেক সদস্য বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এর পরই তাকে প্রথমে সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইসিটি) পদ থেকে সরিয়ে কাস্টমস, এক্সাইজ ও মূল্য সংযোজন কর আপিল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট করা হয়। সেখান থেকেও তাকে সরিয়ে একদিন পরই ওএসডি করা হয়।

• বেলাল হোসেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, গত জানুয়ারিতে আদালতের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ অনুমতি নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সরকারি অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া সফর করে নতুন বিতর্কের জন্ম দেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়।

ঘুষ, নথি ফাঁস ও অসদাচরণের সারি:

গত কয়েক মাসে ঘটে যাওয়া একের পর এক বিতর্কিত ঘটনা:

• নথি ফাঁস: গত ৮ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যানের আয়কর নথি ফাঁসের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির নামে মামলা হয়। এর কয়েক মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য আলোচনার গোপন নথি ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে, যাতে শুল্কনীতি শাখার দ্বিতীয় সচিব মুকিতুল হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত ও পরে মামলা করা হয়।

• ঘুষ ও নথি হস্তান্তর: ঘুষ নিয়ে আয়কর নথি হস্তান্তরের ঘটনায় সহকারী কর কমিশনার জান্নাতুল ফেরদৌস মিতু চাকরি হারিয়েছেন। ৩৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি এসএ গ্রুপের চেয়ারম্যানের ২৩৭ কোটি টাকার সম্পদ বৈধ করতে পুরোনো আয়করের নথি তার আইনজীবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

• হাতেনাতে গ্রেপ্তার: গত ৭ অক্টোবর বেনাপোল কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা শামীমা আক্তারকে এবং ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রাজীব রায়কে ঘুষ গ্রহণকালে দুদক হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

• অসদাচরণ: কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে গত আগস্টে চাকরি হারিয়েছেন সহকারী কর কমিশনার ফাতেমা বেগম।

অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও সমাধানের পথ:

এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় সরকার তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে এবং ২১ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এসব ঘটনায় রাজস্ব আদায়কারী একমাত্র সংস্থাটির অভ্যন্তরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে।

এনবিআর-এর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা মনে করেন, দুর্নীতি কমানোর একমাত্র পথ হলো অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করা। ইতোমধ্যে অনলাইন ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা, আয়কর অডিট সিলেকশন অনলাইন প্রক্রিয়ায় করা, এবং ভ্যাট রিফান্ডও অনলাইনে আনার কাজ চলছে। কর্মকর্তারা আশা করেন, সব কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক হলে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের হয়রানিও কমবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআর-এর এক কমিশনার বলেন, অধিকাংশ কর্মকর্তাই আর্থিক অনিয়মে জড়িত। টাকা ছাড়া এখানে কেউ কাজ করতে চান না। তবে তিনি স্বীকার করেন, সংস্থাটির ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে এবং কিছু কর্মকর্তার কারণে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে, যদিও এখানে অনেক সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা এখনও আছেন।

এসএমআর/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে