ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

ফলের আকাশ ছোঁয়া দাম নিয়ে ক্রেতার বিস্ময়

২০২৪ এপ্রিল ০৭ ১০:৩৭:৩১
ফলের আকাশ ছোঁয়া দাম নিয়ে ক্রেতার বিস্ময়

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের বাজারে দুই বছর আগে যেসব বিদেশি ফলের কেজি ছিল ১৫০ টাকা বা তারও সামান্য বেশি এখন সেই ফল ৩৫০ বা ৪০০ টাকাতেও বিক্রি হয়। প্রশ্ন উঠছে আমদানি করা ফলে কেন বিবেচনায় কর-শুল্ক নেওয়া হবে। আঙ্গুর, আপেল, কমলা, নাশপাতির মত বিদেশি ফলগুলো বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের অংশ হলেও সেগুলোর আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়তি করারোপ বাড়িয়েছে দাম।

গত দুই বছর ধরেই ক্রেতাদের এসব ফলের বাড়তি দর বিস্মিত করছে। খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে কেনা কমিয়েছেন, অথবা বাদ দিয়েছেন অনেক মধ্যবিত্ত ক্রেতারা। রোজার শুরুর দিকের তুলনায় দ্বিতীয় সপ্তাহে গ্রীষ্মকালীন ফলের যোগান বাড়ার পর আমদানি করা ফলের দাম কিছুটা কমেছে, তারপরও যে টাকা খরচ করতে হচ্ছে তা মানুষের ‘অভ্যাসের’ চেয়ে অনেকটাই বেশি।

এ জন্য ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতাকেও দুষছেন ক্রেতারা, যদিও আমদানিকারকদের দাবি, কর যতটা বেড়েছে, দাম ততটা বাড়েনি। তারা বলছেন, শুল্ক হার বাড়ানো আর ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ফলের দাম বাড়ানোর মূল কারণ। এর বাইরে পরিবহন ব্যয়, এলসি খুলতে জটিলতা- এগুলোও অবদান রেখেছে।

অন্যদিকে ক্রেতারা বলছেন, রোজার শুরুর সময় যে দর ছিল, এখন তার চেয়ে কম। এ সময়টুকুতে নিশ্চয় ফল আমদানিতে খরচ কমেনি। তার মানে বাড়তি মুনাফা করা হচ্ছে। বাড়তি দাম মানুষের ভোগে প্রভাব ফেলছে, যদিও পুষ্টিবিদরা বলে থাকেন, সুস্থতার জন্য ফল খাওয়া জরুরি। দিনে জনপ্রতি অন্তত ১০০ গ্রাম ফল খাওয়ার কথা বলছেন তারা।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর থেকে দেশে দেশে যে মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট দেখা দেয়, সে সময় বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচাতে বাংলাদেশ সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়। এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাড়ানো হয় শুল্ক।

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “সরকার অতিমাত্রায় শুল্ক বাড়ানোয় ও ডলারের রেট বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকৃত সব ধরনের ফলের দাম বেড়েছে।”

পীড়া দিচ্ছে দাম-

ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া আবির মাহমুদের প্রিয় ফলের মধ্যে রয়েছে মাল্টা। বাবাও চেষ্টা করেন সন্তানের প্রিয় এই ফলটি এনে দিতে। তবে এ ফলের এমন আকাশ চুম্বি দাম এখন তাকে বড্ড পীড়া দেয়। প্রিয় সন্তানের পছন্দের ফলটা এনে দিতে পারছেন না। যে ফল বছর দুয়েক আগেও তিনি কিনেছেন ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়, এখন তিনশর কমে কেনা দায়, কখনো সখনো দাম ঠেকে চারশতে।

চাকরির সুবাদে ঢাকায় একটি হোস্টেলে থাকেন সিরাজুম মনিরা। তিনি মাঝে মাঝে আপেল বা মাল্টা কেনেন। দাম বেশি হওয়ায় তার সেই অভ্যাসে ছেদ পড়েছে। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, “আগে যে দাম ছিল এখন সেই দাম বা আশপাশে থাকলেও অন্তত এক কেজি করে কিনতে পারতাম। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি দুইটা তিনটা ছাড়া কেনার উপায় নেই।”

যে সিদ্ধান্তের প্রভাব ফল বাজারে-

২০২২ সালের মে মাসে বিদেশি ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে ফল আমদানিতে ঋণ সুবিধা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

সে সময় অপ্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকার এ পদক্ষেপ নেয়।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশে আপেল, কমলা ও নাশপাতির মত বিলাস জাতীয় পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এনবিআর। এতে করে শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কাস্টমস ডিউটি সব বেড়ে যায়। আগে যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে।

এর সঙ্গে আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট তো আছেই।

আনিছুর রহমান নামে একজন ক্রেতা গণমাধ্যমকে বলেন, “ফল শরীরের জন্য খুবই জরুরি একটা খাবার। এটা বিলাসী পণ্য বিবেচনা করা উচিত না।”

দেশি ফল দিয়ে চাহিদা পূরণ সম্ভব নয় জানিয়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সারা বছরের জন্য আমাদের তো বিদেশি ফলের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এত দাম যে কিনে খাওয়ার পরিস্থিতি নাই। শুল্ক কমিয়ে রাখলে সাধারণ মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতায় থাকে। তাতে আমাদের সবার পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে।”

বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, “কাস্টমস শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ, সেটা করেছে ২৫ শতাংশ। আর সম্পূরক শুল্ক ছিল ২০ শতাংশ, সেটা হয়েছে ২৫ শতাংশ। এটা ৫ শতাংশ বাড়া মানে হিসেব করতে গেলে ১৫ শতাংশের সমান। কারণ এখানে ভ্যাটসহ আরও কিছু যুক্ত থাকে।

“সবকিছু মিলিয়ে এখন আমাদের শুল্ক দিতে হয় ১১৫ শতাংশ, যা আগে দিতাম ৯১ শতাংশ। এরপর ভ্যালুয়েশন বাড়িয়েছে। আগে দিতাম ৫০ সেন্টের জন্য ৯১ শতাংশ শুল্ক। এখন ৭০ সেন্টের জন্য ১১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এছাড়া দুই বছর আগে ডলারের রেট ছিল ৮৭ টাকা, এখন ১২০ টাকা।”

টাকার হিসাবে শুল্কে প্রভাবের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “দুই বছর আগে ১৫ কেজি মাল্টায় শুল্ক দিতাম ৭৬০ টাকা, এখন দিচ্ছি ১৪৮০ টাকা।

“জাহাজের ভাড়া অনেক বাড়ানো হয়েছে। আগে যেখানে ২৭০০ ডলার ভাড়া দিতাম। এখন সেটা ৭ হাজার ডলার দিতে হচ্ছে, বিশেষ করে মিশর থেকে।” যে হারে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, ফলের দাম সে হারে বাড়েনি বলেও দাবি করেন তিনি।

ক্রেতার যে প্রশ্নের যুৎসই জবাব নেই-

ফল আমদানিকারকরা কর বৃদ্ধির কথা বললেও দাম এতটা বৃদ্ধি নিয়ে ক্রেতার মনে অন্য প্রশ্ন। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহের পর দাম কিছুটা কমে যাওয়া নিয়ে ক্রেতা কাতিব হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, “ব্যবসায়ীরা বলে ট্যাক্স বেশি তাই দাম বেশি। যদি তাই হয় তবে রমজানের সাতদিন আগে এক দাম, পহেলা রমজানে এক দাম আর এখন রমজানের মাঝামাঝি সময় পরে আরেক দাম কেন।

এই অল্প কয়েক দিনেই দামের যে রহস্যজনক পরিবর্তন, তা স্বাভাবিক নাকি ব্যবসায়ীদের কারসাজি? এই প্রশ্নের জবাব কী? বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দায় দিলেন খুচরা বিক্রেতাদের ওপর। তিনি বলেন, “মার্কেট তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মার্কেট আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে।

তিনি আরো বলেন, আমাদের কাছ থেকে নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা হয়ত বেশিতে বিক্রি করেছে। আর তখন চাহিদা বেশি ছিল। এখন একটু চাহিদা কম, তাই দামও একটু কম।

আকবর খান নামে একজন ক্রেতা ‘রয়ে সয়ে’ কেনাকাটার পরামর্শ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “রোজার শুরুতে আমার কেনাকাটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি। দাম যতই হোক, পরিবার নিয়ে ভালো করে ইফতার করতে হবে, এ চিন্তায় চড়া মূল্যে হলেও বেশি বেশি কিনি। তাই ব্যবসায়ীরা সুযোগ লুফে নেয়। আবার চাহিদা বাড়লে কারসাজি শুরু করবেই।

দেশি ফলের চাপে দরপতন

রোজার শুরুতে বেশ কিছু পণ্যের পাশাপাশি ফলের বাজারেও দেখা দেয় ‘অস্থিরতা’। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহে এতে দেখা যায় বাজারে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ, আনারস, বাঙ্গি, কলা, বেলের সরবরাহ বেড়েছে। দামও কমে এসেছে অনেকটা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, ফলের বৃহৎ আড়ত ওয়াইজ ঘাট ও বাতামতলী ঘুরে দেখা গেছে, কিছু ফলের দাম ১৫ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বেশি যে ফল হালি বা জোড়া বা একটি করে বিক্রি হয়, দাম কমেছে সেগুলোরও।

রোজার শুরুতে যে বেল বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়, একই আকারের বেল এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এছাড়া এখন পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। যা আগে ক্রেতাদের কিনতে হয়েছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে।

শেয়ারনিউজ, ০৭ এপ্রিল ২০২৪

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে