ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

চার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়ছেন ব্যক্তি আমানতকারীরা

২০২৩ সেপ্টেম্বর ২১ ০৭:১৪:৫১
চার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়ছেন ব্যক্তি আমানতকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে ব্যক্তি আমানতকারীদের বের হয়ে যাওয়ারপ্রবণতা থামছে না। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন- এই তিন মাসেই নতুন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন প্রায় ২১ হাজার ব্যক্তি আমানতকারী। আর গত ৯ মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭৫ জন।

তবে একই সময়ে সার্বিক আমানতের পরিমাণ উল্টো বেড়েছে। এর কারণ, এই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর সংখ্যা ৮ হাজারের বেশি বেড়েছে। তার পরও মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে লক্ষাধিক আমানতকারী চলে যাওয়ার ঘটনাকে খাতটির জন্য বড় দুঃসংবাদ হিসেবে দেখছেন অনেকেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই খাতে ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা কমার পেছনে চারটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো- আস্থাহীনতা, সুদে সীমা আরোপ, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও গ্রাহকদের হজ পালন।

বর্তমানে দেশে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু আছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে তারল্য সংকটে।

অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কেউ কেউ। এর মধ্যে অন্তত ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক, যাদের ৩৩ থেকে ৯৯ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তারা অনিয়ম, জালিয়াতি ও যোগসাজশের মাধ্যমে নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। এই কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা কমেছে মানুষের, যা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এর মধ্যেই গত বছরের জুলাই থেকে এ খাতে

আমানত ও ঋণের সুদে সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে মানুষের। এর বাইরে দুই ঈদ ও হজ পালনের কারণে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা হিসাব বন্ধ করে টাকা তুলে নিয়েছেন। এসব কারণে ব্যক্তি আমানতকারীর হিসাব কমে থাকতে পারে।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও আইআইডিএফসির প্রধান নির্বাহী মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া এই বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমার মনে হয়, যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন, তাদের বেশির ভাগই ক্ষুদ্র আমানতকারী। এ কারণে একই সময়ে পুরো খাতের সার্বিক আমানতের পরিমাণ কিন্তু কমেনি। তার পরও আমানতকারী কমে যাওয়ার ঘটনা কারও জন্যই প্রত্যাশিত নয়।

গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, আমানতকারী কমার বেশ কয়েকটি কারণ হতে পারে। বিশেষ করে পিপলস লিজিংয়ের লিকুইডেশন কার্যক্রম শুরুর পর পরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত আস্থার সংকটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে কোডিড ১৯-এর প্রাদুর্ভাব ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এ খাতে তারল্য সমস্যা দেখা দেয়। এর মধ্যেই গত বছরের জুলাই থেকে সুদের সীমা আরোপ করা হয়। এর বাইরে দুই ঈদ ও হজ মৌসুমের সময়েও বেশি আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।

এই খাতের ওপর মানুষের আস্থা বাড়াতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকির কারণে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। পুরো খাতে আমানতের পরিমাণও বাড়তে শুরু করেছে। আশা করছি, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীর সংখ্যাও বাড়বে।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এটা আর্থিক খাতের বিদ্যমান বিশৃঙ্খলা, সমস্যা ও নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে তারই প্রতিফলন। ব্যাংকের ক্ষেত্রে যেমন খেলাপিরা টাকা ফেরত না দিলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই আচরণ দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এখানেও পরিচালক ও কর্মকর্তারা যোগসাজশে নামে-বেনামে ঋণের টাকা তছরুপ করে পালিয়ে গেছেন। ফলে এই খাতের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস ও সন্দেহ বেড়েছে, টাকা রাখলে ফেরত পাওয়া যাবে কিনা এই ভয় ঢুকে গেছে। এর মধ্যেই আমানতের সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সীমা দেওয়ায় গ্রাহকরা আরও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন।

খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের এপ্রিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ওই বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। এক্ষেত্রে ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ এবং আমানতে ৭ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

তারা জানান, উচ্চমূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতের সুদের হার বেঁধে দেওয়ার পর থেকে এ খাতে আমানতকারী কমতে শুরু করেছে। তবে চলতি বছরের জুলাই থেকে সুদের সীমা তুলে নেওয়ায় আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এ খাতে আমানতকারীদের সংখ্যায়ও উন্নতি হতে শুরু করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।

ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা কমছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭০ হাজার ১৯৬টি, যা চলতি বছরের জুন শেষে নেমে এসেছে ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬১টিতে। এর মানে গত নয় মাসের ব্যবধানে খাতটিতে সার্বিক আমানকারীর সংখ্যা কমেছে ১ লাখ ২ হাজার ১৩৫টি।

এই সময়ে পুরুষ আমানতকারী কমেছে ৮০ হাজার ২৯১ জন এবং নারী আমানতকারী কমেছে ৩০ হাজার ৩৮৪ জন। সব মিলিয়ে ৯ মাসে মোট ব্যক্তি আমানতকারী কমেছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭৫টি। একই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার ৫৪০টি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আমানতকারী কমেছে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরÑ এই তিন মাসে। ওই সময়ে খাতটিতে ব্যক্তি আমানতকারী কমে প্রায় ৫১ হাজার ৬৪২ জন। এর পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে কমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার ২৭ জন। আর সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে কমেছে ২০ হাজার ৯২৬ জন।

প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আমানত বেড়েছে

ব্যক্তি আমানতকারীর সংখ্যা কমলেও সার্বিকভাবে গত নয় মাসে আমানত বেড়েছে এ খাতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের পরিমাণ ছিল ৪১ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত নয় মাসের ব্যবধানে পুরো খাতে আমানত বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ তিন মাসে বেড়েছে ৯৮৫ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনÑ এই তিন মাসে আট বিভাগের মধ্যে তিন বিভাগে আমানত কমে গেছে। এগুলো হলোÑ চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী। তবে ঢাকা, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে আমানত বেড়েছে।

খেলাপি ঋণ বাড়ছে

ভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সর্বশেষ মার্চ পর্যন্ত হিসাবে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা, যা এ খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ। এর মধ্যে অন্তত ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার আরও উচ্চমাত্রায় রয়েছে।

এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান। প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৩৩ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। গত ২৭ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সভায় তিনি এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

সভায় প্রতিষ্ঠানগুলোর অনাদায়ী ও খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, আইনানুগ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা এবং যথাযথ তদারকির জন্য প্রধান নির্বাহীদের নির্দেশনা প্রদান করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।

শেয়ারনিউজ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে