ঢাকা, শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

হাসিনার চিকিৎসকের ছেলে ও মন্ত্রীর পুত্রের ‘সিসা বার’ খুলে দিতে তদবির

২০২৫ অক্টোবর ১১ ১১:৪৭:৪০
হাসিনার চিকিৎসকের ছেলে ও মন্ত্রীর পুত্রের ‘সিসা বার’ খুলে দিতে তদবির

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর গুলশান ও বনানীর অভিজাত এলাকায় কয়েকটি সিসা বার পুনরায় চালু করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপের কারণে নারকোটিক্স অধিদপ্তর এখন চরম চাপে রয়েছে।

বনানীর সেলসিয়াস ও এক্সোটিক নামের দুটি সিসা বার আগে আওয়ামী লীগের আমলে পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত। এই সিসা বার দুটির পেছনে ছিলেন ভারতে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের ছেলে, আসিফ মোহাম্মদ নূর। সরকারের পতনের পর এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সম্প্রতি এই সিসা বার পুনরায় চালু করার জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তদবির চালাচ্ছেন।

তদন্তে জানা গেছে, নারকোটিক্স কার্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করছেন শরিফ আল জাওয়াদ নামে এক গাড়ি ব্যবসায়ী, যিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন। নিজেকে প্রভাবশালী প্রমাণ করতে তিনি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তোলা সেলফি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি দেখাচ্ছেন এবং নিজেও বিএনপি নেতা দাবি করছেন। তাঁর গাড়ি বিক্রির প্রতিষ্ঠান ‘ইউনিভার্সাল অটো’ অবস্থিত প্রগতি সরণিতে।

বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে তদবিরের অভিযোগে শরিফ আল জাওয়াদের মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। একইভাবে সেলসিয়াস সিসা বারের মালিক আসিফ মোহাম্মদ নূরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

আওয়ামী লীগ আমলে গুলশান-বনানীতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, মেয়র ও প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় বেশ কয়েকটি সিসা বার গড়ে উঠেছিল। বনানীতে ‘আল গিসিনো’ সিসা বারের পেছনে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে রনি চৌধুরী। গুলশানের কোর্টইয়ার্ড বাজারের সিসা বার পরিচালনা করতেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে, হিট অফিসার বুশরা আফরিন। এছাড়া ‘ফারেন হাইট’ সিসা বার পরিচালনা করতেন শেখ পরিবারের সদস্য শেখ ফারিয়া। তবে গত বছর আগস্টে সরকার পতনের পর তারা অজ্ঞাত স্থানে গা ঢাকা দিয়েছেন।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অনেক সিসা বার রাতারাতি দখল হয়েছে এবং ভোল পাল্টে নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ে হাজির হয়েছে। এ ব্যবসায় অসাধু আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তারা এবং হলুদ সাংবাদিকদেরও সিন্ডিকেট জড়িত। ফলে কঠোর পদক্ষেপের পরও অবৈধ সিসা বার স্থায়ীভাবে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

সরেজমিনে বনানী ১১ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় ‘কিউডিএস’ নামে একটি সিসা বার চলছে। বুধবার বিকালে সেখানে গিয়ে দরজা বন্ধ পাওয়া গেছে। দরজার ফাঁক দিয়ে একজন জানান, ‘সব বন্ধ আছে, গেস্ট ঢুকছে না, পরে খুললে ফোন করবেন।’

সেলসিয়াস ও এক্সোটিক সিসা বার রয়েছে বনানী ১১ নম্বর রোডের ৪৩ নম্বর ভবনে। নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, নারকোটিক্সের কঠোর তদারকির কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। মালিকরা বিষয়টি আলোচনা করছেন, শিগগিরই চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সম্প্রতি নারকোটিক্স বনানীর ‘সিগনেচার’ সিসা বারে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করে মামলা করেছে। সেই সিসা বারটি খুলতে তদবির করছেন তানভির নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে বিএনপি নেতা দাবি করে প্রভাবশালী প্রমাণের জন্য শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ছবি দেখাচ্ছেন।

এছাড়া বনানীর ‘হাভানা ক্যাফে লাউঞ্জ’ এর মালিক রফিক ফরাজি, যিনি আগে আওয়ামী লীগের শেলটারে থেকে সিসা বার চালাতেন, বর্তমানে নিজেকে বিএনপির পদধারী নেতা দাবি করছেন। নারকোটিক্সের সাম্প্রতিক অভিযানের পর তাঁর মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে।

অবৈধ সিসা বার পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতাদের চাপ ছাড়াও মেহেদী নামের এক সরকারি কর্মকর্তা বনানীর ‘অরা’ সিসা বার চালু করতে তদবির করছেন। ‘আল গিসিনো’, ‘থার্টি টু ডিগ্রি’, ‘ক্যাফে এক্সাইল’, ‘দ্য সিলভার লাউঞ্জ’, ‘এস লাউঞ্জ’ ও ‘ইয়া হাবিবিসহ’ আরও কিছু সিসা বার চালাতে প্রভাবশালী সচিবের ছেলে, অতিরিক্ত সচিব ও একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিক হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।

নারকোটিক্স কর্মকর্তারা জানান, অভিযান চালিয়ে সিসা বার বন্ধ করলেও প্রভাবশালীদের তদবিরে শেষ পর্যন্ত নমনীয় হতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান মধ্যরাতে গোপনে কার্যক্রম চালায়। উদাহরণস্বরূপ, বনানী ১১ নম্বর রোডে ‘হেইজ’ সিসা বার বন্ধ হয়ে নাম বদলে ‘সিয়াম লাউঞ্জ’ নামে ফের চালু হয়েছে এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এছাড়া আবাসিক হোটেল ও অভিজাত ফ্ল্যাটেও গোপনে সিসা সেবনের আড্ডা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিসা বারের ভেতরের আলো-আঁধারির পরিবেশ তরুণদের বিপথগামী করছে। অন্ধকার ঘর ও ছোট খুপরিতে তরুণ-তরুণীরা ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পায়, যা নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, সিসায় উচ্চমাত্রায় আসক্তি হয়, যা স্বাভাবিক জীবনযাপন কঠিন করে তোলে। নিয়মিত সিসা সেবনে শ্বাসতন্ত্রের ক্যানসার, নারীর গর্ভধারণে সমস্যা ও চিরস্থায়ী বন্ধ্যত্ব হতে পারে। সিসা বারে যাওয়া তরুণদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে ভয়ংকর মাদক যেমন ইয়াবা ও আইসের আসক্তির ঝুঁকিতে থাকে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, সিসায় ব্যবহৃত নেশা উপকরণে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার নিকোটিন থাকে। মাত্র এক পাফে প্রায় ২০০ সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করে। ধোঁয়া টানার সময় ‘টার’ ও কৃত্রিম ফ্লেভারসহ অন্যান্য রাসায়নিকও শরীরে যায়।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবিত শহুরে অভিজাতদের মধ্যে সিসা সেবন নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা যায়। তারা মনে করেন সিসা তেমন ক্ষতিকর নয়, যেহেতু ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে প্রকাশ্যে সিসা সেবন হয়। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী, সিসায় ০.২ শতাংশের বেশি নিকোটিন থাকলে তা ‘খ’ শ্রেণির মাদক, যার অপরাধে ১ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

অবৈধ সিসা বার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত পরিচালক একেএম শওকত ইসলাম জানান, ‘প্রভাবশালীদের তদবির যতই আসুক না কেন, অবৈধ সিসা বার চালানো আর আমরা বরদাস্ত করব না। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত নজরদারি চালানো হচ্ছে। কোনো অবৈধ কার্যক্রম জানতে পারলেই আমরা তৎক্ষণাৎ অভিযান চালাই এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে