ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

অর্থনৈতিক অবস্থা উত্তরণের বাস্তবভিত্তিক কিছু প্রস্তাবনা

২০২৩ ডিসেম্বর ১৩ ২০:৪৬:০৬
অর্থনৈতিক অবস্থা উত্তরণের বাস্তবভিত্তিক কিছু প্রস্তাবনা

হাফিজ আল আসাদ : এই মুহূর্তে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। বৈশ্বিক মহামারী করোনার পর অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই আচমকা আবির্ভাব হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের মত আমদানি নির্ভর দেশের জন্য এই যুদ্ধের প্রভাব অর্থনীতিতে খুবই নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। যার চাপ পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর এবং যার ফলে রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

বর্তমানে সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এক গ্রুপ নির্বাচনটা সাংবিধানিক সময়ের মধ্যে করার জন্য ব্যতিব্যস্ত। অন্য গ্রুপ সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর নির্বাচন করতে রাজি নয় এবং এই নির্বাচন ঠেকানোর জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করেছে। রাজনীতির এই দোলাচালে দেশে নির্বাচনবিরোধী পক্ষ মনে করছে, যদিও এই নির্বাচনটা হয়ে যায়, তাহলে পশ্চিমা শক্তি আমাদের দেশের উপর বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিধ-নিষেধ আরোপ করবে। যদি পশ্চিমা শক্তিগুলি আমাদের দেশের উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞ আরোপ করে তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপের দিকে ধাবিত হবে।

নির্বাচনের পর নতুন সরকারের চ্যালেঞ্জই হবে অর্থনীতিকে গতিশীল করা। আমাদের অর্থনীতির বর্তমান অনেকগুলো সূচকই চাপের মধ্যে আছে। আমার ব্যক্তিগত পরিচয় দেওয়ার মতো কোন পদ-পদবী নেই এবং আমি কোন অর্থনীতিবিদও নই। তাই অর্থনীতির সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পারবো না। তবে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বাস্তবতার নিরিখে দু’একটি বিষয় নিয়ে নিচে লেখার চেষ্টা করব এই জন্য যে, এতে যদি দেশের কোনো উপকার হয়, সেই আশায়।

বর্তমান অর্থনীতির সূচকগুলির মধ্যে রাজস্ব ঘাটতি, রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে ভাটা তথা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া- এই বিষয়গুলির উপরেই সরকারকে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে ।

রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে প্রধান খাত হলো ইনকাম ট্যাক্স। প্রায় সতের কোটি লোকের দেশে এখন পর্যন্ত মোট ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরর প্রায় নববই লক্ষ এবং সরকার নির্ধারিত ত্রিশে নভেম্বর দুই হাজার তেইশ তারিখের মধ্যে মাত্র সাতাশ লাখ সাতাশি হাজার লোক তাদের রিটার্ন জমা দিয়েছেন। যা জনসংখ্যার অনুপাত অথবা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরেরর অনুপাতে খুবই নগণ্য।

সরকারের এখানে জোর দিতে হবে, কিভাবে করদাতার সংখ্যা বাড়ানো যায় এবং করদাতার কাছ থেকে কিভাবে ন্যায্য কর আদায় করা যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে কর দেওয়ার জন্য। আমি ব্যক্তি শ্রেণীর অনেকের সাথে আলোচনা করেছি এবং দেখেছি যে অনেকেই কর দিতে চায়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় অনেকেই ভয় পায়। তাই কর আদায় বৃদ্ধি করার জন্য করদাতার মনের ভয় দূর করতে হবে, কর দেওয়ার জন্য যে ফর্ম আছে, সেগুলোকে আরো সহজ করতে হবে। কর আদায়কারী ব্যক্তিকে আরো বিনয়ী, দক্ষ, সৎ, সর্বোপরি দেশদরদী হতে হবে। কর আদায়কারীর বিচক্ষণতা এবং সততা রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয়, উনারা যদি একটু সততার সাথে পরিশ্রম করেন তাহলে করদাতা বাড়ানো কোন ব্যাপারই নয়। তাই সরকারকে বলব বাস্তবতার নিরিখে তাদের উপর তদারকি করতে। আমার দেখা একটা ছোট্ট ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আওতাভুক্ত একটি মার্কেটে একদিন কেনাকাটা করছিলাম, হঠাৎ শুনলাম সব দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কেন দোকানপাট বন্ধ করছে, তখন মার্কেটের একজন কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে ইনকাম ট্যাক্স এর অফিসার আসছে, তাই সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছে। পরে আরো দু’চার জনের সাথে আলাপ করে জানতে পারলাম যে, ব্যবসায়ীরা রিটার্ন তো দূরের কথা এখানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ী বা দোকানদারদের ট্রেড লাইসেন্সই নেই। এই যদি হয় সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত একটা মার্কেটের অবস্থা, তাহলে মহল্লার অলিগলির ব্যবসা বা দোকানের কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। তাই কর আদায়কারীকে আরো দক্ষতা ও সততার সাথে দেশমাতৃকার উন্নয়নকল্পে করদাতা নিরূপণ করতে হবে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত কতটুকু মজবুত তা সেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেখে মোটামুটি বুঝা যায়। করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আটচল্লিশ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু করোনার পর অর্থনীতি গতিশীলতার পথে হাঁটা এবং সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর পৃথিবীব্যাপী সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সরকারের আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। ফলস্রুতিতে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সরকার বিভিন্নভাবে রিজার্ভের পতন ঠেকানো চেষ্টা করছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পায় মূলত প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়, বিদেশী বিনিয়োগ এবং বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুদানের মাধ্যমে। সরকার তার বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের জন্য চেষ্টা করবে, পাশাপাশি প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করবে। আমি এখানে সর্বোপরি প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি আয় কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে সম্বন্ধে কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করব।

প্রথমেই আসি প্রবাসী আয়ের দিকে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বৃহৎ অংশ পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং তাদের আয়ের যে অংশটা দেশে পাঠায়, তা যদি আমরা সঠিকভাবে বৈধ চ্যানেলে (ব্যাংকিং ব্যবস্থার) মাধ্যমে আনতে পারি তাহলে এটা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্বাধীনতা লাভের বায়ান্ন বৎসর পরও কেন এখনো আমরা বৈধ পথে আমাদের প্রবাসী ভাইদের কষ্টার্জিত উপার্জনের সর্বোচ্চটা (রেমিটেন্স) আনতে পারি না। বিভিন্ন সময় এই বিষয়ে কথা উঠলে সর্বোচ্চ সংখ্যক মতামত আসে উনারা অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠায় তাই বৈধ পথে টাকা আনার জন্য উনাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে এবং এখন পর্যন্ত এই উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থাটা দুই পার্সেন্ট অথবা আড়াই পার্সেন্ট নগদ প্রণোদনা দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আসলে এই গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আমাদের বের করতে হবে কেন প্রবাসীরা হুন্ডি করে টাকা পাঠায় এবং কি উত্তম ব্যবস্থা নিলে উনারা বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাবে।

কেন প্রবাসীরা হুন্ডি করে টাকা পাঠায় এই কথাটা বের করার জন্য কোন সেমিনার বা বিদেশ যাওয়ার দরকার নেই। দেশ মাতৃকার সেবার মন-মানসিকতা নিয়ে টানা কিছুদিন বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের সাথে কথা বললেই বের হয়ে আসবে কেন তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠায়। তা না করতে পারলে আপনি যতই প্রণোদনা দেন সেটা কোন কাজে আসবে না। কারণ আপনি প্রণোদনা যত দিবেন হুন্ডি ওয়ালারা তার চাইতে আরো বেশি দিবে এবং আমার মনে হয় না যে প্রবাসীরা শুধু বেশি টাকা পাওয়ার জন্য হুন্দিতে টাকা পাঠায় বরং ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে নানা ভোগান্তি অনেকাংশে দায়ী। এজন্য আমার মত ক্ষুদ্র একজন ব্যক্তির মতামত হল (১) কেন হুন্ডিতে টাকা পাঠায় তার প্রকৃত কারণ বের করে তার দ্রুত সমাধান করা। (২) নগদ প্রণোদনার পাশাপাশি এমন একটা ব্যবস্থা বের করা যাতে প্রবাসীরা খুশি মনে সরকার নির্ধারিত বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠায়। যেমন (ক) প্রবাসীদের জন্য একটি ডিপিএসের ব্যবস্থা করা। এখানে যদি ঘোষণা দেওয়া যায় যে কেউ যদি প্রতি মাসে বৈধ চ্যানেলে যে টাকা পাঠাবে তার ফাইভ পার্সেন্ট হিসেবে সরকার তার নমিনির নামে ডিপিএস করে দিবে। ধরা যাক, কেউ দশ হাজার টাকা প্রতি মাসে তার ফ্যামিলির কাছে পাঠায় তাহলে তার নমিনির নামে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা হিসেবে ডিপিএস হবে (খ) যারা বিদেশ থেকে বৈধ পথে টাকা পাঠাবে, তারা তাদের প্রবাস জীবনের মধ্যে যত টাকা পাঠাবে তার উপর সর্বোচ্চ ফিফটি পার্সেন্ট পর্যন্ত উনারা সহজ শর্তে প্রবাস জীবন শেষে ঋণ নিতে পারবে।

আমার ধারণা উপরোক্ত সুবিধাদি দিলে হুন্ডিতে টাকা পাঠানো আশি পার্সেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সরকারের বিভিন্ন সম্মানিত পরামর্শক ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং অনুরোধ করছি, আপনারা যদি কেউ আমার এই লেখাটা পড়ে থাকেন তাহলে যদি সম্ভব হয় আমার উপরোক্ত প্রস্তাবনা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানানোর জন্য। আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের একটা বিরাট অংশ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে না আসার কারণ বা অর্থনীতিতে ভূমিকা না রাখার কারণগুলো নিম্নরূপ:-

১. আমদানি রপ্তানি ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের একটা বিরাট অংশ ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অন্য দেশে পাঠিয়ে দেন;

২. আমাদের দেশে কর্মরত বিভিন্ন গার্মেন্টস বায়িং হাউজ বা বিভিন্ন ব্যবসায়িক মিডিয়াগুলি তাদের পরিচালন ব্যয় যেটা প্রতিমাসে দেশে আনার কথা অথবা পাওয়ার কথা, সেটা নিয়মিতভাবে বৈধ চ্যানেলে না আনা;

৩. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশী কর্মচারী কর্মকর্তাগণের বাস্তব বেতন এবং প্রদর্শিত বেতনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকে এবং এর ফলে আমার দেশ তার প্রাপ্য আয় থেকে বঞ্চিত হয়।

প্রাপ্য রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হওয়ার উপরোক্ত কারণগুলো দক্ষতা ও সততার সাথে পর্যালোচনা করে উপরোক্ত অনিয়মগুলিকে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারলে দেশ তার কাঙ্খিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে এবং বিদেশ নির্ভরশীলতা বা পরনির্ভরশীলতার শৃংখল থেকে দেশ মুক্ত হবে।

শেয়ারনিউজ, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে