ঢাকা, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

কোটি কোটি টাকার শেয়ার এখন মূল্যহীন কাগজ: লুটপাটের চরম মূল্য দিচ্ছে ব্যাংক খাত

২০২৫ ডিসেম্বর ২৭ ১৬:১৭:০৫
কোটি কোটি টাকার শেয়ার এখন মূল্যহীন কাগজ: লুটপাটের চরম মূল্য দিচ্ছে ব্যাংক খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক:২০২৫ সালের শুরুতে ব্যাংকাররা যখন তাদের হিসাবের খাতা খুললেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে দীর্ঘদিনের ধামাচাপা দিয়ে রাখা ক্ষতগুলো আর আড়াল করা সম্ভব নয়। বছরের পর বছর ধরে চলা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঋণের অনিয়ম, বড় বড় কেলেঙ্কারি এবং শিথিল নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিট ভেতরে ভেতরে ফাঁপা হয়ে গিয়েছিল।

ফলে ২০২৫ সালটি ব্যাংকিং খাতের জন্য পুনরুদ্ধারের বছর না হয়ে বরং হয়ে দাঁড়িয়েছে এক কঠিন ‘হিসাব-নিকাশের’ এর বছর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাংক একীভূতকরণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তকরণ, নতুন আইন এবং কঠোর তদারকির মতো কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিলেও বছর শেষে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বেশ উদ্বেগজনক।

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায়, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এটি গত এক বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি এবং ২০০০ সালের পর সর্বোচ্চ।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এক ডজনেরও বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় বড় করপোরেট গ্রুপগুলোর খেলাপি হওয়ার প্রবণতা এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

এদিকে ব্যাংকিং খাতের এই অস্থিরতা চলেছে প্রতিকূল সামষ্টিক অর্থনীতির মধ্যেই। মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের আশেপাশে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদ হার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখায় ঋণের সুদহার ১৬ থেকে ১৭ শতাংশে পৌঁছায়। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ রেকর্ড পর্যায়ে নেমে আসে এবং নতুন বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ে। নিজের জমানো টাকার নিরাপত্তা নিয়ে আমানতকারীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়।

ব্যাংক একীভূতকরণ,শেয়ারমূল্য শূন্য ঘোষণা ও আমানতকারীদের ভোগান্তি

বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পাঁচটি সংকটাপন্ন শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ গঠন। ৩০ অক্টোবর লাইসেন্স পাওয়া এই ব্যাংকটি দেশের বৃহত্তম ইসলামী ব্যাংকে পরিণত হয়, যার পরিশোধিত মূলধন ৩৫,০০০ কোটি টাকা (এর মধ্যে ২০,০০০ কোটি টাকা সরকারের)।

যেসব ব্যাংক নিয়ে এই নতুন ব্যাংক গঠিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংক একীভূতকরণের সময় শাখাগুলোতে আমানতকারীদের উপচে পড়া ভিড় এবং নগদ অর্থ উত্তোলনে ব্যর্থতা চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিলেও অনেক গ্রাহক তাদের টাকা ফেরত পাননি।

এদিকে একীভূত হওয়া এই ৫ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ারমূল্য শূন্য ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকগুলোর ওপর কর্তৃত্ব হারিয়েছে মালিকরা। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের ৩৩ ধারার আওতায় এই পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের শেয়ার শূন্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রেজল্যুশনের অধীন তফসিলি ব্যাংকের মূলধন ও যোগ্য দায়সমূহ হ্রাস অথবা রূপান্তর করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এটা মূলত হিসাবের বিষয়। তবে এর মাধ্যমে এসব ব্যাংকের শেয়ারধারীর শেয়ার কার্যত শূন্য হয়ে যাবে। তাঁদের আর কোনো দাবি থাকবে না।

এই সংকট সামাল দিতে সরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করে:

ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ২০২৫: এর মাধ্যমে ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর হস্তক্ষেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়।

আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫: আমানত বিমার পরিমাণ ১ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়, যা দেশের ৯৩ শতাংশ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেবে।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২’ সংশোধনের উদ্যোগ আমলাতান্ত্রিক বাধার মুখে পড়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ বিলুপ্ত করার দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

ইতিবাচক দিক: বৈদেশিক খাত

ব্যাংকিং খাতের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মাঝেও স্বস্তি দিয়েছে বৈদেশিক খাত। হুন্ডি ও হাওলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩০.০৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৫৭ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি।

২০২৫ সাল শেষ হতে চললেও ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটেনি, তবে দীর্ঘদিনের লুকানো ক্ষতগুলো উন্মোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক সুরক্ষা দুর্বল হয়েছে এবং ব্যাংকগুলো সংস্কারের প্রাথমিক সরঞ্জামগুলো তৈরি হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মানসিকতাই ঠিক করে দেবে—এই সংস্কার স্থায়ী হবে নাকি ব্যবস্থাটি ভঙ্গুরই থেকে যাবে।

এমজে/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে