ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
Sharenews24

জমি আইন নিয়ে ভূমি আইনজীবীদের সতর্কতা

২০২৫ অক্টোবর ২৪ ১০:০৮:১৫
জমি আইন নিয়ে ভূমি আইনজীবীদের সতর্কতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে জমি সংক্রান্ত বিরোধের সবচেয়ে সাধারণ ও জটিল প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি হলো— “দলিল বড়, রেকর্ড বড়, নাকি দখল বড়?”। প্রায় প্রতিটি ভূমি মামলায় এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে। একটি জমির দলিল একজনের নামে, রেকর্ড (খতিয়ান) আরেকজনের নামে, আবার জমিতে বসবাস বা দখল থাকে তৃতীয় কারও হাতে— এমন ঘটনাই বাস্তবে বেশি দেখা যায়।

তাহলে আইনের দৃষ্টিতে আসল মালিক কে? জমির মালিকানা নির্ধারণে কোন উপাদান বেশি গুরুত্বপূর্ণ— রেকর্ড, দলিল নাকি দখল?

ভূমি আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, জমির মালিকানা নির্ধারণে এই তিনটি উপাদান— রেকর্ড, দলিল এবং দখল— সমান গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কোনটির আইনি শক্তি বেশি হবে তা নির্ভর করে তাদের ধারাবাহিকতা ও প্রমাণের দৃঢ়তার ওপর। আদালতে একটির গুরুত্ব অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে বিবেচিত হয়।

রেকর্ড (খতিয়ান): মালিকানার মূল ভিত্তি

বাংলাদেশে ভূমি মালিকানার আইনি ভিত্তির প্রথম ধাপ হলো রেকর্ড বা খতিয়ান। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একাধিক ভূমি জরিপ সম্পন্ন হয়েছে— যেমন সিএস (C.S.), এসএ (S.A.), আরএস (R.S.), বিএস (B.S.), সিটিজ সার্ভে (City Survey), এবং সর্বশেষ বিডিএস (বাংলাদেশ ডিজিটাল সার্ভে)।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিএস রেকর্ড হলো মালিকানার “মূল শেকড়” বা প্রাথমিক ভিত্তি। যদি কোনো ব্যক্তি তার জমির মালিকানার ইতিহাস সিএস রেকর্ড থেকে শুরু করে সর্বশেষ রেকর্ড (যেমন বিএস বা সিটিজ) পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে সেই রেকর্ড আদালতে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

গুরুত্বপূর্ণ দিক:

শুধু একটি খতিয়ানে নাম থাকা যথেষ্ট নয়। আদালতে প্রমাণ করতে হয়, সেই খতিয়ানটি কীভাবে পূর্ববর্তী রেকর্ড থেকে এসেছে— অর্থাৎ মালিকানার Chain of Title বা ধারাবাহিকতা দেখাতে হয়।

দলিল: মালিকানা হস্তান্তরের আইনি প্রমাণ

দলিল হলো জমি ক্রয়, দান, উত্তরাধিকার বা অন্য কোনো উপায়ে মালিকানা হস্তান্তরের লিখিত আইনি চুক্তিপত্র। তবে দলিল থাকলেই মালিকানা নিশ্চিত হয় না। আদালতে দলিলের বৈধতা যাচাইয়ের সময় দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিবেচিত হয়—

ক) জমি বিক্রেতা বা দাতা কি আইনত ওই জমির মালিক ছিলেন?

খ) তার মালিকানা কি সিএস বা পরবর্তী রেকর্ডের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

যদি বিক্রেতার নামে বৈধ রেকর্ড না থাকে, অথবা তার মালিকানার শৃঙ্খল ভাঙা থাকে, তাহলে তার করা দলিল আইনি দিক থেকে অকার্যকর বা জাল প্রমাণ হতে পারে।

বিশেষ মন্তব্য:

একটি বৈধ দলিল সবসময় রেকর্ডের ধারাবাহিকতার অংশ হতে হবে। রেকর্ডবিহীন বা অস্পষ্ট মালিকানার ওপর ভিত্তি করে তৈরি দলিল আদালতে টিকতে পারে না।

দখল: শর্তসাপেক্ষ মালিকানা অধিকার

বাংলাদেশের আইনে দখলও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবে এটি “শর্তসাপেক্ষ” অধিকার। সাধারণভাবে মনে করা হয়— “যার দখল, তার জমি”— কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এত সহজ নয়।

তামাদি আইন (Limitation Act) অনুযায়ী, কেউ যদি একটানা ১২ বছর বা তার বেশি সময় ধরে প্রকাশ্যে, নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং মালিকানার দাবিতে কোনো জমি দখলে রাখেন, এবং ওই সময়ে মূল মালিক কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি, তাহলে দখলদার বিরুদ্ধ দখল (Adverse Possession) সূত্রে মালিকানা দাবি করতে পারেন।

তবে এর জন্য কয়েকটি কঠোর শর্ত পূরণ জরুরি:

দখলটি হতে হবে প্রকাশ্য ও প্রকাশ্যে স্বীকৃত।

দখল হতে হবে নিরবচ্ছিন্ন ও বাধাহীন।

মূল মালিকের জ্ঞাতসারে হতে হবে।

সতর্কতা: অবৈধ বা জোরপূর্বক দখল কখনোই আইনি মালিকানা দেয় না, যদি মূল মালিকের কাছে বৈধ রেকর্ড ও দলিল থাকে।

বাংলাদেশের ভূমি আইনের আলোকে, তিনটি উপাদানের মধ্যে কোনো একটির ভিত্তিতে এককভাবে মালিকানা নির্ধারণ করা যায় না। প্রকৃত মালিক তিনিই হবেন—

✅ যিনি সিএস রেকর্ড থেকে সর্বশেষ রেকর্ড পর্যন্ত মালিকানার ধারাবাহিকতা প্রমাণ করতে পারেন;

✅ যার নামে বৈধ দলিল আছে, যা সেই রেকর্ডের ধারাবাহিকতার অংশ;

✅ এবং যিনি সেই দলিল ও রেকর্ড অনুযায়ী আইনসঙ্গতভাবে দখলে আছেন।

ভূমি আইনজীবীদের মতে, জমি কেনার আগে শুধুমাত্র বিক্রেতার দলিল বা দখল দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া বিপজ্জনক। কেনার আগে অবশ্যই সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও ভূমি অফিসে গিয়ে সংশ্লিষ্ট জমির সিএস থেকে সর্বশেষ রেকর্ড পর্যন্ত খতিয়ান ও দলিলের সম্পূর্ণ ধারাবাহিকতা (Chain of Title) যাচাই করতে হবে।

কারণ, বাংলাদেশের ভূমি আইনে ভুল বা জাল দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি কেনার পর ক্ষতিপূরণ আদায়ের পথ অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। তাই যাচাই-বাছাইই হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ পদক্ষেপ।

মুয়াজ/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে