ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Sharenews24

লোকসানি শেয়ার নিয়ে বড় কারসাজি: নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ বন্ধ কেন?

২০২৫ সেপ্টেম্বর ২৬ ১৯:৩০:৫৪
লোকসানি শেয়ার নিয়ে বড় কারসাজি: নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ বন্ধ কেন?

বিশেষ প্রতিবেদন: শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক কারসাজির ইতিহাসে জিকিউ বলপেন যেন এক জীবন্ত উদাহরণ। যে কোম্পানি টানা কয়েক অর্থবছর ধরে লোকসানের গহ্বরে ডুবে আছে এবং কোনো শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি দেখাতে চরমভাবে ব্যর্থ, সেই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে। বাজারের দর চিত্র দেখলে মনে হতে পারে, এই কোম্পানি বুঝি প্রতি মুহূর্তে পাহাড়সম মুনাফা করছে—অথচ বাস্তবে, প্রতিষ্ঠানটি এখনো লোকসানের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পায়নি। এই অস্বাভাবিক উত্থানই প্রশ্ন তুলেছে শেয়ারবাজারের শৃঙ্খলা নিয়ে।

সর্বশেষ ৫৭২ টাকা ৪০ পয়সায় লেনদেন হওয়া এই কোম্পানির শেয়ার মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে ডিএসইতে সাপ্তাহিক দর বৃদ্ধির তালিকায় জিকিউ বলপেন শীর্ষে। তবে কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক প্রতিবেদন দেখলে এই আকাশচুম্বী দর বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না, যা কেবল লোকসানের গভীরতাকেই বড় করে তোলে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, জিকিউ বলপেন টানা তিন বছর ধরে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে ঋণাত্মক মুনাফা দেখাচ্ছে। ২০২৪ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩ টাকা ৫০ পয়সা, ২০২৩ সালে ছিল ১২ পয়সা এবং ২০২২ সালে লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ টাকা ৬৫ পয়সা। এর মাঝেও কোম্পানিটি ২০২৪ সালে ৩ শতাংশ এবং তার আগের দুই বছরে ২.৫০ শতাংশের মতো ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, জিকিউ বলপেনের শেয়ারে বিনিয়োগের পক্ষে কোনো যুক্তিই নেই। প্রতিষ্ঠানটির পিই রেশিও নেতিবাচক এবং আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু মাত্র ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন থাকার কারণে কারসাজিকারীরা সহজেই এই শেয়ার নিয়ে ইচ্ছামতো খেলা করছে এবং এর দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে চলেছে।

বিপরীতে, একই খাতের একটি শক্তিশালী ও মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)-এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিএসসি ২০২৪ সালে ২৫ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছে এবং চলতি ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে তাদের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ১৪ টাকা ২৮ পয়সায় পৌঁছেছে—যা তাদের ধারাবাহিক আর্থিক উন্নতির প্রমাণ। তা সত্ত্বেও বিএসসির শেয়ার এখনো ১২০ টাকার নিচে লেনদেন হচ্ছে। অন্যদিকে, মাত্র কয়েক মাস আগে ১৬০ টাকার নিচে থাকা লোকসানি জিকিউ বলপেনের শেয়ার আজ ৫৭২ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। প্রশ্ন হলো: মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি যেখানে অবমূল্যায়িত, সেখানে লোকসানে থাকা শেয়ারটি কেন এমন অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে?

বিনিয়োগকারীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং ডিএসই'র চোখের সামনেই এই কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি এবং দর বৃদ্ধির অনৈতিক খেলা চলছে। তাদের বিস্ময়, কেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সাধারণত দেখা যায়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন এবং কারসাজিকারীরা বিপুল মুনাফা নিয়ে বাজার থেকে সরে পড়ে, তখনই কেবল তাদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো উদ্যোগ নেওয়া হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কারসাজিকারীদের অর্জিত বিশাল অবৈধ মুনাফার তুলনায় যে নামমাত্র জরিমানা করা হয়, তা কার্যত তাদের জন্য এক ধরনের সবুজ সংকেত। এই দুর্বল ব্যবস্থা কারসাজিকারীদের আরও বেশি সাহস জুগিয়ে চলেছে। শেয়ারবাজারে প্রকৃত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে শুধুমাত্র জরিমানা করাই যথেষ্ট নয়; বরং কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং বাস্তবায়নযোগ্য শৃঙ্খলামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় শেয়ারবাজার ক্রমাগত একদল প্রভাবশালী কারসাজিকারীর বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হবে, যেখানে নিয়মিত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কেবল সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

মামুন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে