ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
Sharenews24

ঋণ কেলেঙ্কারির পর তিন ব্যাংকের নাটকীয় ঘুরে দাঁড়ানো

২০২৫ নভেম্বর ২০ ২৩:১৮:১৫
ঋণ কেলেঙ্কারির পর তিন ব্যাংকের নাটকীয় ঘুরে দাঁড়ানো

নিজস্ব প্রতিবেদক: বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি ও আতঙ্কজনক আমানত উত্তোলনের সংকট কাটিয়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি তিন বাণিজ্যিক ব্যাংক—ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক—আবার ঘুরে দাঁড়ানোর শক্ত লক্ষ্যণ দেখাচ্ছে। এক বছরেরও বেশি সময় পর ব্যাংক তিনটিতে আমানতকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে এবং ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসেই তিন ব্যাংকই শক্তিশালী দুই অংকের আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

তবে দেশের মোট ব্যাংক আমানতের প্রায় ১৫ শতাংশ ধারণকারী এই ব্যাংকগুলোতে আমানত ফেরায় খাতটিতে ইতিবাচক সাড়া মিললেও মারাত্মক মূলধন ঘাটতি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফলে ব্যাংকগুলো নতুন আমানত থেকে আয় করতে পারছে না এবং ব্যবসা সম্প্রসারণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তিন ব্যাংকের আগের বোর্ড ভেঙে দিয়ে বড় পরিবর্তন আনে। তখন ইউসিবি মুক্ত হয় সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের প্রভাব থেকে; ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রণ থেকে; আর আইএফআইসি মুক্ত হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কর্তৃত্ব থেকে। বোর্ড শুদ্ধির পর এখন তিন ব্যাংকই রাইট শেয়ার, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড এবং কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনার মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালাতে ফরবিয়ারেন্স দিলেও প্রভিশন ঘাটতি বহাল রয়েছে। নতুন শেয়ার বা বন্ড ইস্যু করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সহযোগিতা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমি) আলী মনে করেন, ব্যাংকের মূলধন পুনর্গঠনে পুঁজি সংগ্রহের প্রধান উৎস হওয়া উচিত পুঁজিবাজার। তবে নতুন শেয়ার ইস্যুর কারণে মালিকানা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় কিছু পরিচালক আপত্তি করতে পারেন। তার মতে, পরিস্থিতির ব্যতিক্রমী অবস্থা বিবেচনায় বিএসইসিকে কয়েকটি কঠোর নিয়ম শিথিল করা উচিত—কারণ পর্যাপ্ত মূলধন ছাড়া ব্যাংক খাত স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। তবে উচ্চ মন্দ ঋণ (এনপিএল) ও নিম্ন মূলধনের কারণে কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে নতুন শেয়ার ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। এমনকি কয়েকজন ব্যাংকার জানিয়েছেন—বহুবার চেষ্টা করেও তারা বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে আলোচনা সভা নিশ্চিত করতে পারেননি।

ইউসিবির ক্ষেত্রে জানুয়ারি–সেপ্টেম্বরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি নেট আমানত প্রবাহ তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। এ সময়ে মোট আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা—যার ৫৬ শতাংশই এসেছে সাধারণ খুচরা গ্রাহকদের কাছ থেকে। ব্যাংকটি সিআরআর, এসএলআর ও এডিআর নিয়ম মানতে পারলেও মূলধন সংকট বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে সিআরএআর ছিল ৭.৬৯ শতাংশ, যা ন্যূনতম ১০ শতাংশের চেয়ে কম। এই অবস্থায় তারা পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ সমমূল্যের শেয়ার কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে ইস্যুর ঘোষণা দেয় এবং আরও ৭৭৫ কোটি টাকার রাইট শেয়ার ও ৮০০ কোটি টাকার সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করে। কিন্তু বিভিন্ন কমপ্লায়েন্স শর্তের কারণে প্রস্তাব চার মাস ধরে বিএসইসিতে ঝুলে আছে। ইউসিবির এমডি মনে করেন, আগের বোর্ডের দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের বোঝা রাতারাতি কাটানো সম্ভব নয়, এবং এই সংকট কাটাতে এখন কৌশলগত বিনিয়োগকারী আকর্ষণ অত্যন্ত জরুরি।

ইসলামী ব্যাংকও ঘুরে দাঁড়ানোর দারুণ অগ্রগতি দেখিয়েছে। এস আলম গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি কেলেঙ্কারির পর ব্যাপক আমানত প্রত্যাহার হলেও ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসেই প্রায় ১৫ শতাংশ আমানত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। নেট আমানত বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তাদের রেমিট্যান্স প্রবাহও আবার শীর্ষ অবস্থানে ফিরেছে। তবে দীর্ঘদিনের গোপন খেলাপি ঋণের বোঝায় সিআরএআর নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে এবং ৮৬ হাজার কোটি টাকার বড় প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। ব্যাংকটির এখনো মূলধন সংগ্রহ পরিকল্পনা নেই, কারণ এস আলম গ্রুপের হাতে থাকা ৮২ শতাংশ শেয়ার বাংলাদেশ ব্যাংক জব্দ করেছে। আদালতের রায় অনুযায়ী এসব শেয়ার লিকুইডেট করা হলে নতুন কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

আইএফআইসি ব্যাংকও গত বছরের আগস্টের অস্থিরতার পর আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তিন মাসে ৫ হাজার কোটি টাকা আমানত হারালেও এক বছর পরে তারা ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি নতুন আমানত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে। বোর্ড সংস্কারের পর ব্যাংকটি আবার ঋণ বিতরণ শুরু করেছে। তবে ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি এবং কম মূলধনের কারণে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণও সীমিত। ব্যাংকের এমডি জানান, তাদের ৩০ শতাংশের বেশি শেয়ার সরকার মালিকানায় থাকায় তারা সরকারি সহায়তায় মূলধন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। একইসঙ্গে তারা এসএমই ব্যাংকিং সম্প্রসারণে জোর দিচ্ছে এবং দেশের বিস্তৃত উপশাখা নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সালাউদ্দিন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে