ঢাকা, শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

হাসিনা একজন রক্তচোষা-সাইকোপ্যাথ: উপদেষ্টা নাহিদ

২০২৪ সেপ্টেম্বর ২৭ ১৫:০৫:৫৪
হাসিনা একজন রক্তচোষা-সাইকোপ্যাথ: উপদেষ্টা নাহিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেখ হাসিনাকে এক সময় পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ছাত্র-জনতা দুর্বার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি গোপনে ভারতে পালিয়ে যান।

সেই ছাত্র-জনতা আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত মুখ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র নাহিদ ইসলাম, যিনি ছিলেন সেই গণআন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক। দুই বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি।

শেখ হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পান তিনি।

মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিন চলতি সেপ্টেম্বরে এক রোববার সন্ধ্যায় নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার নেয়। তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিজ দপ্তরের কাঠের প্যানেলে সাজানো কক্ষে অভিজাত এক কালো চামড়ার চেয়ারে বসে শান্ত কণ্ঠে টাইমকে তিনি বললেন, ‘হাসিনা রক্তচোষা ও সাইকোপ্যাথ (মানসিকভাবে অসুস্থ)। ’

নাহিদ ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক। আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন তিনি। এখন তিনি আইসিটি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। গত জুন মাসে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে নাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যান। সেখানে প্ল্যাকার্ড হাতে ছাত্র রাস্তায় নামার আহ্বান জানান।

এর আগে হাইকোর্ট বিতর্কিত কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে। এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থায় বিশেষ সুবিধা রাখা হয়। বিপরীতে নাহিদ ও তার সহযোদ্ধারা সবার জন্য ন্যায্য সুযোগ দাবি করেন।

২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে প্রথম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তখন সরকার শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেলে বিক্ষোভেরও ইতি ঘটে। এ বছরও সরকার পিছিয়ে গেলে কোটা ব্যবস্থা নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন শেষ হয়ে যেতে পারত। এমনটাই জানালেন নাহিদ ইসলাম।

তবে শেখ হাসিনার নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ নামে এক ছাত্রনেতা নিহত হন। পুলিশের সামনে দুই হাত খুলে বুক সামনে দিয়ে দাঁড়ালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা মান।

উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সেই হত্যাকাণ্ড আন্দোলনের জন্য গেম-চেঞ্জিং মুহূর্তে পরিণত হয়। ’ ছাত্র আন্দোলন দ্রুত দেশজুড়ে জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে আচ্ছন্ন করে।

তিনি বলেন, এ আন্দোলন দেশের মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রকাশ করার একটি সুযোগ করে দেয়।

দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীদের দৃষ্টি পড়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। ৩ আগস্ট ছাত্ররা তার পদত্যাগের এক দফা দাবি তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সেই দাবির ঘোষণা দেন নাহিদ ইসলাম।

এরপর ৫ আগস্ট লাখো ছাত্র-জনতা ঢাকায় শেখ হাসিনার বাসভবনের দিকে যাত্রা শুরু করলে তিনি গোপনে হেলিকপ্টার করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পালিয়ে যান। তিনি এখন সেখানে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন।

চেয়ারে বসে সামনে-পেছনে দুলতে দুলতে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কেউ ভাবেনি তার (শেখ হাসিনার) উৎখাত হবে। ’

এরপর সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে, শিক্ষার্থীরা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ১৭ কোটি মানুষের দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব দেয়।

ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জন্য খ্যাতি পাওয়া এ অর্থনীতিবিদ হাসিনা সরকারের আনা আইনি অভিযোগের কারণে হেনস্থার শিকার ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকে তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পান।

নাহিদ ইসলমা মন্ত্রণালয়ে নিজের টেবিলে একটি লাল ল্যান্ডলাইনের দিকে নির্দেশ করে বলেন, ‘ভিআইপি ফোন। ’ তিনি বলেন, ‘এটি কী জন্য ব্যবহার করা উচিত, আমি জানি না। আমি মুহাম্মদ ইউনূসকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করি। ’

উপদেষ্টা নাহিদের একান্ত সচিব (পিএস)-কে দেখে মনে হচ্ছিল চাপে থাকা এক কর্মকর্তা, যিনি তার চেয়ে বেশি বয়সী। কক্ষে আসছেন, যাচ্ছেন, সই করানোর জন্য কাগজপত্র হাতে রাখছেন।

নাহিদের দুটি মোবাইল ফোনে ক্রমাগত রিং বেজে যায়। ভোর থেকেই তার বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত। একটি ঝাড়বাতি এবং সাদা মখমলের সোফা দিয়ে সজ্জিত তার বসার ঘরটি প্রায় তার পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টের মতোই বড়।

নাহিদ ইসলামের বাবা পেশায় একজন শিক্ষক। ঢাকায় জন্ম নেওয়া নাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম সপ্তাহেই সুন্দরবনে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেন। ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনে লড়েন। পরে তিনি সহপাঠীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি- নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

নাহিদ ইসলাম সবচেয়ে বড় পরিচিতি পান চলতি বছরের জুলাইয়ে গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে। আগের সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধে সরকারের সমালোচকদের জোরপূর্বক গুম করার অভিযোগ রয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমকে নাহিদ ইসলাম জানিয়েছিলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে ছিলেন তিনি। এক রাতে সাদা পোশাকে প্রায় ৩০ গোয়েন্দা কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত হন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, তাদের মাথায় কালো কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাদের বলা হয়, ‘পৃথিবী আর কোনো দিন তোমাদের দেখতে পাবে না। ’

নাহিদ ইসলামের বিশ্বাস, গোপন কারাগারে তাকে রাখা হয়েছিল। তাকে পেটানো হয়। তার মনে হচ্ছিল, লোহার রড দিয়ে পেটানো হয়েছিল। হাতের বাহু ও পায়ে পেটানোর দাগও ছিল। ব্যথা, যন্ত্রণাদায়ক শব্দ এবং তাক করা উজ্জ্বল আলোর তীব্রতায় তার মাথা ঘোরাচ্ছিল; পাশাপাশি তিনি মাঝে মাঝেই অচেতন হয়ে যাচ্ছিলেন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, কর্মকর্তারা তার কাছে জানতে চাচ্ছিলেন, ‘মাস্টারমাইন্ড কে? টাকা কোত্থেকে আসছে?’ তুলে নেওয়ার একদিন পর তিনি নিজেকে একটি ব্রিজের পাশে আবিষ্কার করেন। তার শরীরে আঘাতের চিহ্নের ছবি স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়।

নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গোয়েন্দা বাহিনী কেবল পরিচিত মুখদের, বিশেষ করে আমাদের আন্দোলনের নেতার খোঁজ করছিল। তবে আমরা কেবল একজন ছিলাম না। এটিই ছিল আমাদের প্রধান শক্তি।’

নাহিদ ইসলামকে দেখেই মনে হচ্ছে, বেশ আত্মবিশ্বাসের ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব ছিল দলগত- এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যম সবসময় একটি মুখ খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু আমি একাই এ আন্দোলনের নেতা নই। আমরা অনেকেই ছিলাম। ’

নাহিদের ফোন আবার বেজে ওঠে। তাকে ঢাকার একটি হাসপাতালে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা চিকিৎসকদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তাদের এক সহপাঠী অবহেলায় মারা গেছেন, এমন অভিযোগ এনে তারা হামলা চালান। এ নিয়ে চিকিৎসকরা ধর্মঘট ডেকেছেন।

মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় আরও একটি ফোনকল এলো। জানতে চাওয়া হলো, ইউনূসের দপ্তর সরকারি চাকরির দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকজনকে তার নম্বর দেবে কি না।

ভোট কারচুপি, সমালোচকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন এবং ভয়ের সাধারণ পরিবেশের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা ১৫ বছরের শাসনের পর তাদের কণ্ঠস্বর শোনানোর সাফল্যে বাংলাদেশিরা বেশ উজ্জীবিত। লোকজন নতুন স্বাধীনতা ভোগ করছেন।

নারীরা হয়রানির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার বিরোধিতা করছে, স্থগিত চাইছে। ঢাকায় কিছু অংশে স্কুলের শিক্ষার্থীদেরও বিক্ষোভ করতে দেখা যাচ্ছে, কারণ তাদের প্রিন্সিপালকে তারা পছন্দ করে না।

নাহিদ ইসলাম ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘১৫ বছরের বেশি সময় ধরে লোকজন কথা বলতে পারছিল না। এখন তারা সুযোগ পেয়েছে।’

আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এখন নতুন সরকারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সামরিক বাহিনী বা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে এমন একটা দীর্ঘস্থায়ী আশঙ্কাও রয়েছে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনের আগে দুর্নীতি নির্মূল করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ। ‘আমরা এখানে খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছি।’

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি ও সহিংসতা- লোকজন আর চায় না,’ বলেন তিনি। ‘আমাদের নতুন প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ’

মিজান/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে