ঢাকা, শুক্রবার, ২১ নভেম্বর ২০২৫
Sharenews24

বিপাকে শেয়ারবাজারের ৩১১ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজ

২০২৫ নভেম্বর ২১ ২০:১৯:৫৮
বিপাকে শেয়ারবাজারের ৩১১ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ধারাবাহিক মন্দার গভীর আঘাতে কেবল সাধারণ বিনিয়োগকারীই নয়, কাঁপুনি ধরেছে সারা শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও। ভয়াবহ লোকসানের কারণে বর্তমানে প্রভিশনিং ঘাটতিতে ধুঁকছে ৩১১টি বাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ২১১টি স্টেকহোল্ডার, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ৩৬টি স্টেকহোল্ডার এবং ৪৪টি মার্চেন্ট ব্যাংক। সবমিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট প্রভিশনিং ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।

লোকসানের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণে ২০১৬ সাল থেকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছরই এসব প্রতিষ্ঠান আবেদন করে সময় বাড়িয়ে যাচ্ছে। রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশনও চলতি অর্থবছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের সময় বৃদ্ধি করেছে। গত এপ্রিল মাসের কমিশন সভায় সময় বৃদ্ধি করে ৩০ জুনের মধ্যে প্রভিশনিং সংরক্ষণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে কমিশনে জমা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু দু-একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগই তাদের পরিকল্পনা জমা দেয়নি। এরই প্রেক্ষিতে গত ১৩ নভেম্বর বিএসইসি’র কমিশন সভায় মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস মিলিয়ে ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে প্রভিশন সংরক্ষণে তাদের কর্মপরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানো হয়।

এ বিষয়ে বিএসইসি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব প্রতিষ্ঠান প্রভিশনিং সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, কমিশন তাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে সময় বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা প্রভিশনিং সংরক্ষণ করতে পারছে না। এজন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের মেয়াদ রয়েছে উল্লেখ করে তারা জানান, ওই সময় শেষ হওয়ার আগে তাদের ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই।

প্রভিশনিংয়ের বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, শেয়ারবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মন্দা বিরাজ করছে। ফলে বড় ধরনের আনরিয়েলাইজড লস তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিগত কমিশন শেয়ারবাজারে পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস আরোপ করার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ আটকে যায় এবং তাদের ইক্যুয়িটি ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমও সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়তি মুনাফা করতে না পারার কারণে প্রভিশন সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি বছরের আগস্ট মাসের তথ্যানুযায়ী, ডিএসই’র ২১১টি স্টেকহোল্ডারের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আনরিয়েলাইজড লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৯০৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা; এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের পরিমাণ ৯১৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। সিএসই’র ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের ২২ কোটি ১৩ লাখ টাকা আনরিয়েলাইজড লোকসানের বিপরীতে প্রভিশনিংয়ের পরিমাণ ১০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অপরদিকে ৪৪টি মার্চেন্ট ব্যাংকার্সের মোট আনরিয়েলাইজড লোকসানের পরিমাণ ১ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। এই লোকসানের বিপরীতে প্রভিশনিং করা হয়েছে ৬৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই হিসাবে মোট ৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার আনরিয়েলাইজড প্রভিশনিংয়ের বিপরীতে ১ হাজার ৫৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা প্রভিশনিং করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ২ হাজার ১৫৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে দেশের শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধসের পর শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর মূল্য কমতে থাকে। বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা তৈরি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই মন্দার কবলে থাকে বাজার। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মূল্য ঋণাত্মক হয়ে পড়ে। বিনিয়োগমূল্য কমে গেলেও বিক্রি না করার কারণে আনরিয়েলাইজড লসের শিকার হয় তারা। অ্যাকউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী আনরিয়েলাইজড লসের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি পরিপালন করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রভিশনিংয়ের পরিমাণ প্রতি অর্থবছর ই বাড়তে থাকে। কিন্তু মন্দাবাজারে মুনাফা করতে না পারার কারণে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রভিশন সংরক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধুমাত্র মন্দার কারণেই শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগমূল্য কমেছে, এমনটি নয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো শৃঙ্খলা বা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। বিনিয়োগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনারও কোনো বালাই নেই। কোনো ধরনের বাছ-বিচার ছাড়াই লোকসানি কোম্পানিতেও বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু নিজস্ব পুঁজিই নয়, ব্যাংক বা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ করেও এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু লোকসান হবে এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি না করে ধরে রেখেছে। এতে একদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে, অপরদিকে আটকে গেছে বিনিয়োগ। শেয়ারবাজারে তারল্য সংকটের এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি লোকসানের মুখে রয়েছে তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। অধিক মুনাফার লোভে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। ২০০০ সালের দিকে এবি ব্যাংক শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে বড় ধরনের মুনাফা করে। সেই সময় এবি ব্যাংকের মুনাফার বিষয়টি অন্যান্য ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করে। ২০০৯ সালে শেয়ারবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করলে অনেক ব্যাংক সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হিসাবে মার্চেন্ট ব্যাংক গঠন করে। শেয়ারবাজারে ২০১০ সালের ধসের পর থেকে এসব প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছে এবং প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে বড় ধরনের বিপাকে রয়েছে তারা।

সালাউদ্দিন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে