ঢাকা, সোমবার, ২১ জুলাই ২০২৫
Sharenews24

বকেয়া মেটাতে না পারায় এবার উচ্ছেদের মুখে রিং শাইন টেক্সটাইল  

২০২৫ জুলাই ২১ ০৬:৫৪:১১
বকেয়া মেটাতে না পারায় এবার উচ্ছেদের মুখে রিং শাইন টেক্সটাইল  

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি রিং শাইন টেক্সটাইল তাদের প্রাক-প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু কেলেঙ্কারির পর এবার বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কাছে বকেয়া পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গভীর সংকটে পড়েছে। এর ফলে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত তাদের ছয়টি প্লট থেকে উচ্ছেদ হতে পারে কোম্পানিটি।

কোম্পানি সূ্ত্রে জানা গেছে, প্লট ২৩১ থেকে ২৩৬ থেকে উচ্ছেদ হলে রিং শাইন টেক্সটাইল তাদের ইটিপি (Effluent Treatment Plant) এর রিজার্ভ ট্যাংক হারাবে, যা কারখানার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। এই নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে কারণ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বৃহস্পতিবার তাদের ১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১২ কোটি টাকা) আইপিও তহবিল থেকে বেপজাকে বকেয়া পরিশোধের জন্য অর্থ ছাড়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। কোম্পানিটি তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিয়ে এই অর্থ ছাড়ের আবেদন করেছিল।

রিং শাইন টেক্সটাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিরুদ্ধ পিয়াল বিএসইসির সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ সিদ্ধান্ত নিতে সাত মাস সময় নিয়েছে—যা অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ।

তার ভাষায়, “যদি সিদ্ধান্তটি আরও আগে আসত, তাহলে আমরা ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে বিকল্প তহবিল জোগাড়ের চেষ্টা করতে পারতাম। এখন সেই সুযোগ আর নেই।”

তিনি আরও জানান, কোম্পানির জমি বা প্লট ধরে রাখার আর কোনো উপায় নেই, কারণ বেপজা যেগুলো নিলামে তুলতে উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে করা রিট আবেদন আদালত ইতোমধ্যেই খারিজ করে দিয়েছে।

অনিরুদ্ধ পিয়াল আরও উল্লেখ করেন, ‘যদিও আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো উচ্ছেদের নোটিশ পাইনি, তবে আংশিক পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হওয়ায় কোম্পানিকে প্লট খালি করতে হবে। যদি আমরা প্লট হারাই, তাহলে নতুন একটি রিজার্ভ ট্যাংক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে।’

এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেছেন, কোম্পানির সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং বিনিয়োগকারীদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যানের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, এজিএমে শেয়ারহোল্ডারদের প্রায়শই সম্পূর্ণ এবং সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয় না। যখন কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, তখন তা সাধারণত পাস হয়ে যায়। তবে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন এবং কমিশনের নিজস্ব মূল্যায়নের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বেপজার ফেব্রুয়ারিতে জারি করা একটি চিঠি অনুযায়ী, রিং শাইন টেক্সটাইলের কাছে কর্তৃপক্ষের বকেয়া সেই মাস পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ ডলার ছিল। জানুয়ারিতে বেপজার সাথে এক বৈঠকে কোম্পানিটি প্রায় ১০ লাখ ডলার ডাউন পেমেন্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তারা মাত্র ১ লাখ ৫৫ হাজার ডলার পরিশোধ করতে পেরেছে। রিং শাইন টেক্সটাইল প্রাথমিকভাবে জানুয়ারিতে শেয়ারহোল্ডার এবং কোম্পানির স্বার্থে ১০ লাখ ডলার ছাড়ের জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করেছিল। বিএসইসি প্রায় সাত মাস পর জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে এই আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে।

অনিরুদ্ধ পিয়াল জানান, কোভিড-১৯ এর প্রভাব থেকে সেরে ওঠার পর এবং বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে নতুন অর্ডার পাওয়ার পর রিং শাইন টেক্সটাইলের ব্যবসা উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কোম্পানির ব্যবসায় অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আগে আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করতো, তাহলে কোম্পানি বেপজার কাছে তাদের বকেয়া আংশিকভাবে পরিশোধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে পারতো।

রিং শাইন ২০১৯ সালে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। মহামারীর সময় রপ্তানি আদেশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় কোম্পানিটি সমস্যার সম্মুখীন হয়।

২০২০ সালের ২২ অক্টোবর তহবিল সংগ্রহের জন্য সম্মতিপত্রের শর্তাবলী মেনে না চলার কারণে বিএসইসি কোম্পানির আইপিও অ্যাকাউন্ট জব্দ করে। প্রাথমিকভাবে জব্দ করা তহবিলের পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ৫ কোটি টাকার বেশি সুদ-সহ প্রায় ৪০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

কোম্পানি এবং এর শেয়ারহোল্ডারদের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, জব্দকৃত আইপিও তহবিলে অর্জিত নামমাত্র সুদ। রিং শাইন টেক্সটাইল তাদের আইপিও তহবিলের ১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্র্যাক ব্যাংকের একটি চলতি অ্যাকাউন্টে রেখেছিল, যেখানে তারা মাত্র ০.০৭৫ শতাংশ সুদ পেয়েছে। তাদের বিদেশি মুদ্রার অ্যাকাউন্টে থাকা ১.৭৮৬ মিলিয়ন ডলার, ৬ হাজার ৮৪৭ পাউন্ড এবং ২ হাজার৭০৬ ইউরোতে কোনো সুদই জমা হয়নি।

গত অক্টোবরে রিং শাইন টেক্সটাইল বিএসইসির কাছে অ্যাকাউন্ট এবং পণ্যের ধরন পরিবর্তনের, অথবা উচ্চ সুদের জন্য তহবিল অন্য ব্যাংকে স্থানান্তরের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয়। টেক্সটাইল সংস্থাটি অর্জিত সুদ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসাবে ব্যবহারের জন্য মুক্তি দেওয়ারও অনুরোধ করেছিল। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই আবেদনের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

চিঠিতে রিং শাইন তাদের বর্তমান সুদের হারের সাথে বিকল্প ব্যাংকগুলোতে আরোপিত বার্ষিক ১৪ শতাংশ সুদের বিশাল পার্থক্যের উপর জোর দেয়। কোম্পানিটি উল্লেখ করেছিল, আইপিও তহবিলের উপর এই নগণ্য সুদ "সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে আর্থিক সুযোগে উল্লেখযোগ্য ক্ষতির" প্রমাণ।

অনিরুদ্ধ পিয়াল বলেন, আইপিও তহবিল সাধারণ বিনিয়োগকারীদের টাকা, যা প্রায় চার বছর ধরে ব্যাংকে খুব সামান্য সুদে পড়ে আছে এবং এর ফলে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হচ্ছে। যদি কমিশন অ্যাকাউন্টের ধরন পরিবর্তন বা তহবিল অন্য ব্যাংকে স্থানান্তরের অনুমতি দিতো, তাহলে কোম্পানি তহবিল থেকে যথেষ্ট পরিমাণ সুদ অর্জন করতে পারতো।

রিং শাইন টেক্সটাইলস লিমিটেডের বর্তমান সংকটের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আইপিও জালিয়াতি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তে উঠে এসেছে, বিতর্কিত কর কর্মকর্তা মতিউর রহমান, এফএআর গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের ফারুক এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত একটি সিন্ডিকেট প্রকৃত কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই কোম্পানির নতুন শেয়ার ইস্যু করে শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।

এই জালিয়াতি চক্রে কোম্পানির সাপ্লাই চেইন এজেন্ট এবং ভারতীয় নাগরিক অশোক কুমার চিরিমারের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণও পাওয়া গেছে।

এ অবস্থায়, গত ৭ জুলাই বিএসইসি রিং শাইনের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনের বিরুদ্ধে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই তালিকায় রয়েছেন কোম্পানির স্পনসর, সাবেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নির্বাহী পরিচালক, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব—এছাড়াও নাম রয়েছে আব্দুল কাদের ফারুক ও অশোক কুমার চিরিমারের।

মামুন/

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে