ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

ফের চালু হচ্ছে হাসিনা সরকারের ‘দায়মুক্তি’পাওয়াদের দুর্নীতির ফাইল

২০২৪ আগস্ট ২২ ০৭:২০:১৯
ফের চালু হচ্ছে হাসিনা সরকারের ‘দায়মুক্তি’পাওয়াদের দুর্নীতির ফাইল

নিজস্ব প্রতিবেদক : শেখ হাসিনা সরকারের আমলে লাল ফিতায় বন্দি ছিল দলীয় মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের দুর্নীতির বড় বড় ফাইল। সেই সময়ে গণহারে মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের দুর্নীতির অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘ক্লিনচিট’ বা দায়মুক্তি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এখন ওইসব মন্ত্রী-এমপি-সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সম্পদের অনুসন্ধান ফের সচল হচ্ছে।

কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক ঢেলে সাজানো না হলে এসব কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত আগের মতোই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’তে পরিণত হতে পারে মনে করছেন খোদ দুদক কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য-কর্মকর্তাদের হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটতে নামায় কমিশন। ফলে বিগত দিনে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে খুব কম সংখ্যক অনুসন্ধান আলোর মুখ দেখেছে। বেশিরভাগ বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ রাজনৈতিক ও অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিসমাপ্তি করা হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, খুব শিগগিরই দুদক ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কমিশন পদত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েও রেখেছে। শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা। এরই মধ্যে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদক ঢেলে সাজানোর পরই দুর্নীতিবিরোধী কার্যকর অভিযান শুরু হবে। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে এর আগে প্রভাব খাটিয়ে যেসব মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘দায়মুক্তি’ নিয়েছেন তাদের তালিকাও করা হচ্ছে।

জানা গেছে, গত কয়েক দিনে বছরের পর বছর আটকে থাকা বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান প্রতিবেদনের সুপারিশ আমলে নিয়ে মামলার অনুমতি দিয়েছে কমিশন। সবশেষ বুধবার ডাক বিভাগের আলোচিত সাবেক মহাপরিচালক শুধাংশু শেখর ভদ্রের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এই কর্মকর্তা ডাক বিভাগের নামে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি নগদ পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এটাসহ ডাক বিভাগের নানা দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত দীর্ঘদিন হিমাগারে ছিল। সম্প্রতি তোড়জোড় শুরু হলে বুধবার শুধাংশু শেখর ভদ্র ও ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল মোস্তাক আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর আগের দিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস আশরাফুল আলম খোকনের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের দুর্নীতির অনুসন্ধান শেষে গত বছর প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। সেই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে ‘কোয়ারি’ দিয়ে ফাইল ফেরত পাঠায় কমিশন। কোয়ারির নামে ফাইলটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঙ্গলবার তাকসিম এ খানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে বিষয়টি দৃশ্যপটে আনেন। এমন অনেক বড় দুর্নীতিবাজের ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা হলেও অনুসন্ধান ধামাচাপা পড়ে ছিল। এখন সেগুলো গতি পাচ্ছে।

দুদকের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলেছেন, গত ১৬ বছরে বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা দূরের কথা, সরকার না চাইলে অনুসন্ধান শুরু করাই যেত না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধান চালুর পর দুর্নীতির সুস্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলেও অভিযোগ পরিসমাপ্তি করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিশেষ করে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটে চাঞ্চল্যকর শত শত দুর্নীতির ফাইল চাপা পড়ে আছে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য-চুনোপুঁটি ধরার ক্ষেত্রে দুদক স্বাধীন। কিন্তু রাঘববোয়াল ধরতে হাত বাড়াতেই পারেন না তারা। সরকারের বিরাগভাজন হওয়ায় মাঝেমধ্যে দু-চারজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নামে মিডিয়া ট্রায়াল করা হয়েছে। মিডিয়া থেমে গেলে দুদকের কাজও থেমে গেছে। দলীয় সরকারগুলো কখনো দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয় না। এবার সত্যিকার অর্থে দুদককে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সুযোগ এসেছে। এমন কাজ করতে হবে যাতে সরকার বদলালেও দুদক বদলাতে না পারে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বাইরে ব্যক্তিস্বার্থে কেউ যেন দুদককে ব্যবহার করতে না পারে। প্রতিষ্ঠানটি যেন দুর্নীতিবাজদের কাছে আতঙ্কের নামে পরিণত হয়।

বিগত ১৬ বছরে নানা সময়ে গণমাধ্যমের চাপে কিংবা সরকারের সাময়িক ইশারায় কিছু ‘রুই-কাতলা’ ধরার কাজ শুরু করে দুদক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জাল কেটে বেরিয়ে গেছে। এমনকি কেউ কেউ একাধিকবার অভিযোগ পরিসমাপ্তি করে ‘দায়মুক্তি’ নেন। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দুর্নীতিবাজদের নতুন করে অনুসন্ধানের আওতায় আনতে তালিকা করছে একটি সংস্থা। নতুন করে সাজানোর পরই এই তালিকা দুদকের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তালিকা করতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন, একজন ব্যক্তির অভিযোগ চারবার পরিসমাপ্তি করার ন্যক্কারজনক নজির স্থাপন করেছে দুদক। এই ব্যক্তি হলেন-ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআরের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান। আলোচিত ডায়মন্ড ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা দীলিপ কুমার আগরওয়ালার দুর্নীতির অভিযোগ দুবার পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। দীলিপের বিরুদ্ধে ডায়মন্ডের কারবারে বিপুল সম্পদ গড়া ও বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য ওপেন সিক্রেট। তার ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় ডায়মন্ড জুয়েলারি শোরুম আছে। কিন্তু তিনি বিদেশে বিনিয়োগের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেননি। দীলিপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে বিদেশে শোরুমের তথ্য প্রকাশিত থাকলেও দুদক রহস্যজনক কারণে তার দুর্নীতির খুঁজে পায়নি।

সন্দ্বীপের আলোচিত ‘দুর্নীতিবাজ’ সাবেক সংসদ-সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার দুর্নীতির অভিযোগ একাধিকবার পরিসমাপ্তি করে দুদক। অথচ স্থানীয় মানুষ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির এন্তার অভিযোগ করে। দেশে-বিদেশে তার বিপুল সম্পদের তথ্যও ওপেন সিক্রেট। অথচ দুদক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে ‘দায়মুক্তি’ দেয়।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের দেড় বছরে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন ৮ সংসদ-সদস্য। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ-সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু তার বিরুদ্ধে দুদফা দুর্নীতির অভিযোগের পরিসমাপ্তি করিয়ে ‘ক্লিনচিট’ নিতে সক্ষম হন। অথচ তার অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি ও তথ্যপ্রমাণসহ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রচার-প্রকাশিত হয়েছে। সরকার পতনের আগেই অবস্থা বেগতিক দেখে বিদেশে পাড়ি জমান বাবু।

এছাড়াও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ, চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ-সদস্য শামসুল হক চৌধুরী, ভোলা-৪ আসনের সংসদ-সদস্য আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ-সদস্য আফজাল হোসেন, শেরপুর-১ আসনের সংসদ-সদস্য আতিউর রহমান আতিক ও সাবেক সংসদ-সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও বিএম মোজাম্মেল হক দুদক থেকে ‘দায়মুক্তি’ পেয়েছেন। আর দুর্নীতির অভিযোগে ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ-সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ-সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, রাজশাহী-১ আসনের সংসদ-সদস্য ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী, মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপ ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে বিকল্পধারার সংসদ-সদস্য মাহী বি চৌধুরীর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। এদের দুর্নীতির ফাইল এতদিন অচল থাকলেও এখন সচল হচ্ছে।

শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্র-এমপি-নেতারের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চালু হওয়ার প্রক্রিয়ার চালু হওয়ার মধ্যেই দুদকের তালিকায় সোমবার যুক্ত হয়েছে নতুন আরও ৪১ সাবেক মন্ত্রী-এমপির নাম।

মামুন/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে