ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
Sharenews24

খেলাপি ঋণে ডুবছে ব্যাংক খাত

২০২৫ জুলাই ২৯ ১২:৩০:১৪
খেলাপি ঋণে ডুবছে ব্যাংক খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি। এর মূল কারণ হলো বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা অর্থনীতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতির পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দেওয়া অগ্রহণযোগ্য ঋণ। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব ব্যবসায়ী নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়েছিলেন, সেগুলোর বড় অংশই এখন অনাদায়ী রয়ে গেছে।

সরকার পরিবর্তনের পর এসব ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের দেওয়া ঋণগুলোই বেশি খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতির মন্দাবস্থা ও নতুন ঋণ শ্রেণিকরণের নিয়ম যোগ হয়ে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জুন মাসে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি ঋণ এখন অনাদায়ী।

এর আগে ২০২৫ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, তখন হার ছিল ২৪.১৩ শতাংশ।অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জুনে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে একটি রেকর্ড।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সাবেক সরকারের সময় নামে-বেনামে যেভাবে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো এখন একে একে খেলাপি হিসেবে ধরা পড়ছে। শুধু তাই নয়, ঋণ শ্রেণিকরণের নতুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (নতুন নীতিমালা) চালু হওয়ায় অনেক ঋণ দ্রুত অনাদায়ী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

এর পাশাপাশি নবায়ন করা বহু ঋণ আদায়যোগ্য না হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলোকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনকালে মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এরপর প্রায় প্রতি বছরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।

অর্থনীতিবিদদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল, তৎকালীন সরকার-ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন, যার বড় অংশই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে।

সরকার পতনের পরই সেই সময়কার দেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করে। রাজনৈতিক চাপ ও সুবিধা দিয়ে যেভাবে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছিল, পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানোর জন্য একের পর এক নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল—বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই নীতিগুলো থেকে সরে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে খেলাপি ঋণে ডুবে থাকা পাঁচটি ইসলামি ধারার ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৭০ শতাংশ।

তথ্যসূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও বহুল সমালোচিত চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পর ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা বের হয়ে আসছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে।

সরকারি খাতের অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক, এবং বেসরকারি খাতের আইএফআইসি, ইউসিবি, এনআরবি ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক-সহ প্রায় সব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

বর্তমানে প্রায় ১,২০০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বিশেষ বিবেচনায় ঋণ নবায়নের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে এরই মধ্যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন নীতিমালার আওতায় এখন ঋণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ না হলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হয় এবং ৯০ দিন পর তা খেলাপিতে রূপান্তরিত হয়। এ নিয়ম কার্যকর হয়েছে ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে।

বর্তমানে খেলাপি ঋণে শীর্ষে রয়েছে:

অগ্রণী ব্যাংক

জনতা ব্যাংক

সোনালী ব্যাংক

রূপালী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক

আইএফআইসি ব্যাংক

ন্যাশনাল ব্যাংক

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক

ইউনিয়ন ব্যাংক

খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি দেশের ব্যাংক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট বাড়ছে, সুদহার বাড়ছে, আর ঋণ প্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়ছে—যা সরাসরি শিল্প, ব্যবসা ও কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি হয়ে পড়েছে:

রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ঋণ বিতরণ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ জোরদার

খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর আইন প্রয়োগ

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতামূলক অর্থনৈতিক সংস্কার

মুসআব/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে