ঢাকা, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
Sharenews24

গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের যেসব কৌশলে ঘুরে দাঁড়াল রিজার্ভ

২০২৫ এপ্রিল ২০ ১০:৪৮:১৭
গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের যেসব কৌশলে ঘুরে দাঁড়াল রিজার্ভ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্বস্তির হাওয়া বইছে। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৫১ বিলিয়ন ডলার, যা আইএমএফের বিপিএম-৬ মানদণ্ডে ২১.১৭ বিলিয়ন ডলার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন, আমদানি শৃঙ্খলা, এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে নেওয়া সাহসী পদক্ষেপগুলো রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের রিজার্ভ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ছিল ২০২১ সালে – ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ, ও অভ্যন্তরীণ দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে তা ক্রমাগত কমতে থাকে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে রিজার্ভ নেমে আসে ২৪.১৯ বিলিয়ন ডলারে, যা বিপিএম-৬ মতে ছিল মাত্র ১৮.৪৬ বিলিয়ন।

২০২৫ সালে এসে প্রথমবার ২৬ বিলিয়ন ছাড়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয়বার ১৫ এপ্রিল। মূল চালিকা শক্তি ছিল রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, হুন্ডি প্রতিরোধ এবং সরকারের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ।

২০২৫ সালের মার্চ মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে একক মাসে সর্বোচ্চ। এর আগেই ফেব্রুয়ারিতে আসে ২.৫২ বিলিয়ন ডলার—গত বছরের তুলনায় ২৫% বেশি।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রবাসী আয় ছিল ২১.৭৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে আগের বছর একই সময়ে ছিল ১৬.৬৯ বিলিয়ন ডলার। সরকারের পক্ষ থেকে রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাড়িয়ে ৩%-এ উন্নীত করা এবং কিছু ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫% পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়ক হয়।

২০২৪ সালের আগস্টে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক নেয় একাধিক কঠোর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। যেমন: হুন্ডি প্রতিরোধে মোবাইল কোর্ট ব্যবস্থা, বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক খাতে নিরীক্ষা ও দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ বাতিল, রেমিট্যান্সে আস্থা ফেরাতে আইনি ও নীতিগত সহায়তা

এই পদক্ষেপগুলো খুব দ্রুত ফল দিতে শুরু করে। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক ঋণ পুনঃসমন্বয়ের মাধ্যমে রিজার্ভে চাপ কমে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে আমদানি ব্যয় ছিল ৮২.৫০ বিলিয়ন ডলার, তা কমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হয় ৬৩.২২ বিলিয়ন ডলার। এই হ্রাসের প্রধান কারণ ছিল: বিলাসবহুল পণ্যে এলসি খোলায় কড়াকড়ি, জ্বালানি ও পুঁজি খাতে ব্যয় হ্রাস, অপ্রয়োজনীয় আমদানি বন্ধ

তবে রিজার্ভ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে আমদানি আবার বেড়েছে ৪.৪৪%—যা সুসংবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধ করেছে ২.৬৩৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ ১.৯৬২ বিলিয়ন ও সুদ ৯৪৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, রিজার্ভ বাড়লেও ঋণ পরিশোধ কমেনি।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে কিস্তি পুনঃসমন্বয়ের পদক্ষেপ, যেমন কিছু চীনা ও বহুপাক্ষিক ঋণের শর্ত মওকুফ বা সময় বৃদ্ধির ফলে তাৎক্ষণিক চাপ কমে।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ব্যাংকগুলো এখন আগের তুলনায় সহজে এলসি খুলছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে এলসি খোলা হয় ৪৭.২৮ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.৬২% বেশি।

শুধু ফেব্রুয়ারিতেই এলসি খোলা হয়েছে ৬.২৬ বিলিয়ন ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২০% বেশি।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন,“রেমিট্যান্সই এখন সবচেয়ে কার্যকর বৈদেশিক আয়ের উৎস। সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সুফল দিচ্ছে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, “আমদানিতে নজরদারি বাড়ানো, এলসিতে শৃঙ্খলা ও বাজারে ডলার ব্যবস্থাপনায় সরকারের কঠোরতা রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করেছে।”

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক সময় ভয়াবহ চাপের মধ্যে ছিল। তবে বাস্তবমুখী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, নতুন নেতৃত্ব, এবং রেমিট্যান্সের ওপর জোর দিয়ে মাত্র সাড়ে সাত মাসে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে।

তবে এই অর্জন ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন স্থায়ী নীতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবাসী আয়ের উৎসগুলোর উন্নয়ন। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখনই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা—যা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে।

কেএইচ/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে