ঢাকা, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সংকট এবং তার সমাধান  

২০২৫ ফেব্রুয়ারি ২৩ ১০:৪৬:১৩
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের সংকট এবং তার সমাধান
 

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রশ্ন ওঠে, একটি দেশে কত ব্যাংক প্রয়োজন? বিশেষ করে, বাংলাদেশের সীমিত ভৌগোলিক পরিসরে অতিরিক্ত ব্যাংক এবং শাখার বিস্তার দেশী-বিদেশী অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে, বিগত স্বৈরাচারী সরকারের ১৬ বছরে রাজনৈতিক কারণে ১৬টি নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। শোনা যায়, যে কোনো সরকার পরিবর্তন হলে ব্যাংক ও মিডিয়া উভয়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখা হয়, যাতে সরকারী প্রচারে সুবিধা পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে, "বেশি ব্যাংক, বেশি লুটপাট, বেশি মিডিয়া, বেশি অপপ্রচার" এবং এই দুটি কাজের জন্য ফ্যাসিবাদী সরকার প্রায় সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল।

আইএফআইসি ব্যাংকের আধিপত্য:

বর্তমানে, আইএফআইসি ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের শীর্ষে অবস্থান করছে। ব্যাংকটির ১৪০০টিরও বেশি শাখা রয়েছে, যা বাংলাদেশে কোন ব্যাংকের পক্ষ থেকে শাখার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ব্যাংকটির মালিক সালমান এফ রহমান এবং তার ব্যাংক ঋণ রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে এত ব্যাংক এবং শাখা বিদেশি কোনো উন্নত দেশে দেখা যায় না।

বেসরকারি এবং সরকারি ব্যাংকের অবস্থা:

বাংলাদেশে ৬০টিরও বেশি ব্যাংক রয়েছে, যার মধ্যে সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি ব্যাংক এবং বিদেশি ব্যাংক সমন্বয়ে এক বিশাল ব্যাংকিং কাঠামো তৈরি হয়েছে। তবে, এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা যথেষ্ট অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দূরদর্শিতা না থাকার কারণে বেশ কিছু ব্যাংক বর্তমানে রেড জোন বা ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং রূপালী ব্যাংক প্রভৃতি ব্যাংক এই অবস্থানে রয়েছে।

এছাড়া, কিছু ব্যাংক যেমন সোনালী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক রেড জোনের কাছাকাছি অবস্থান করছে। এসব ব্যাংক আর্থিক দুর্বলতার কারণে স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না।

ব্যাংকিং খাতের সংকট:

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সংকট হলো কুঋণ বা মন্দঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক এর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঋণের ৯.৯৩% হচ্ছে কুঋণ, যার মধ্যে অনেক ব্যাংক মন্দঋণ সমস্যায় ভুগছে, বিশেষত সরকারি ব্যাংকগুলো।

এছাড়া, ব্যাংক লুট এবং ব্যাংক ঋণ বিতরণে অনিয়ম বেড়ে চলেছে। অনেক ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে বা ঋণের বিপরীতে যথাযথ জামানত রাখছেন না। এর ফলে ব্যাংকিং খাতের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাচ্ছে এবং জনসাধারণ ব্যাংক থেকে তাদের আমানত তুলে নিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকও তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো দুর্বল নীতিমালা প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতার অভাব।

এস আলমের উদাহরণ:

ব্যাংক খাতের ক্ষতির জন্য অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এস আলম। তিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছেন এবং ওই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা বোর্ড নিজের পছন্দমত নিয়োগ দিয়েছেন। এর ফলস্বরূপ, ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক তাদের নিয়মের বাইরে গিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, যা ব্যাংক খাতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় শুদ্ধতার অভাব:

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সুশাসনের অভাব। ব্যাংক মালিকরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাংক পরিচালনা করে, যার ফলে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। এছাড়া, ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং যোগ্য কর্মকর্তার নিয়োগ নেই। এসব কারণেই অনেক ব্যাংকের ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।

ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠন:

এই অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকরী তদারকি এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং ঋণ প্রদানের নিয়মগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করা প্রয়োজন। এছাড়া, কুঋণ চিহ্নিতকরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ দল গঠন করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ:

বর্তমানে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য অনেক কাজ হচ্ছে, তবে খেলাপি ঋণ এবং অর্থ পাচার যে পরিমাণ বেড়েছে, তা ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। এজন্য, বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের জন্য স্বচ্ছতা, সুশাসন, নিয়ম-কানুন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, তেমনি নানা সমস্যায় নিমজ্জিত। ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট খাতের পুনর্গঠন, সুশাসন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি।

এনামুল/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে