ঢাকা, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

কালো টাকা যাদের মাধ্যমে পাচার করা হয়

২০২৪ মে ১৬ ১৭:৫০:৪৭
কালো টাকা যাদের মাধ্যমে পাচার করা হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ আগে ক্যাসিনোর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হতো। ২০১৯ সালের শেষভাগে র‌্যাব-পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের পর তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। তবে এসব জুয়াড়িদের অনেকে এখন নতুন করে অনলাইন জুয়ার দিকে ঝুঁকেছে। সেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে।

এছাড়া দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালরা প্রতিরাতে নামিদামি হোটেল ও বারের অবৈধ গানের জলসায় দু’হাতে কালো টাকা উড়াচ্ছে। যা ঘুরে-ফিরে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খায়েস মেটাতে দুর্নীতিবাজ চক্র হয়ে উঠছে আরও বেপরোয়া। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের পাচার রোধে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তৎপরতা বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) অনলাইন জুয়া বন্ধে সম্প্রতি বেটিং সাইট ও অ্যাপগুলোর তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। দেশের কোন জেলায় কোন অ্যাপ বা সাইট ব্যবহৃত হচ্ছে তা জানার জন্য দেশের সব জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে হোটেল-বারের অবৈধ জলসায় কোটি কোটি টাকা উড়ানো দুর্নীতিবাজদের অবৈধ আয়ের উৎস খুঁজতে গোয়েন্দারা মাঠে নামছেন। একই সঙ্গে মধুচক্রের আসর জমানো হোতাদের টাকা কোন পথে কীভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে তার রুট খোঁজা হচ্ছে।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০০ হোটেল ও বারে প্রতিরাতে গানের জলসা বসছে। এর মধ্যে হাতেগোনা মাত্র চার থেকে পাঁচটি হোটেলে এই ধরনের অনুষ্ঠান করার অনুমতি রয়েছে। বাকি হোটেলগুলো স্থানীয় থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে এ অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে।

এসব জলসার সামনের সারিতে বসে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা বার সিঙ্গারদের গানের তালে তালে মধ্যরাত পর্যন্ত মদপান করছে। এই সময় তারা পাঁচশ’ ও হাজার টাকার নোটের বান্ডিল খুলে শিল্পীদের গায়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। তবে প্রতিরাতে প্রতিটি জলসায় প্রকাশ্যে ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা উড়ানো হলেও গোপন লেনদেনের পরিমাণ কোটি টাকার কম নয় বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজরা শুধু মদ ও মিউজিক জলসায় টাকাই নষ্ট করেনি, সেখানকার বার সিঙ্গারদেরও কালো টাকা পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা হোটেল বার থেকে নারী শিল্পীদের মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে সফরসঙ্গী হিসেবে নিয়ে যায়। এই সময় বিভিন্নভাবে টাকা পাচার হয়। এর বিনিময়ে তাদের দেয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা।

সম্প্রতি তৃপ্তি বিশ্বাস নামে এক নারী বারের গায়িকা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। জানা গেছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী এই গায়িকার তৃপ্তি বিশ্বাসের নামে বর্তমান পাসপোর্ট থাকলেও মুসলিম নামে আরেকটি পাসপোর্ট কর হয়েছে। মুসলিম পাসপোর্টে প্রতিবেশী দেশ ভারতে বহুবার গিয়েছেন।

মানব নামের এক ভারতীয় নাগরিক তার সঙ্গে যুক্ত। যা নিয়ে মানবকে বিভিন্ন হোটেলে তৃপ্তির সঙ্গে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কালো টাকার মালিকরা তৃপ্তি বিশ্বাস মানবকে ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করছেন। তৃপ্তি বিশ্বাস সম্প্রতি মানি লন্ডারিংয়ে তার বাবা-মাকে জড়িত করার জন্য মানবের মাধ্যমে ভারতীয় ভিসার ব্যবস্থা করেছিলেন বলে জানা গেছে।

এছাড়া চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী হাফিজ, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শ্যামলের সঙ্গে তৃপ্তি বিশ্বাসের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তাদের লা-ভিঞ্চি, হলিডে ইন, পূর্বাণী, সেরিনা এসব হোটেলের বারে একাধিকবার একসঙ্গে দেখা গেছে। এসব তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে।

জানা গেছে, আরও একাধিক কালো টাকার মালিক তৃপ্তি বিশ্বাসকে ব্যবহার করে বিদেশে অর্থ পাচার করছে। যদিও ওই নারীর নিকটাত্মীয়-স্বজনরা এ অভিযোগ অসত্য বলে দাবি করেছেন। তবে অবৈধ অপতৎপরতার সঙ্গে যুক্ত না থাকলে সামান্য একজন বার সিঙ্গার কীভাবে দামি গাড়ি হাঁকান এবং বেকার স্বামী নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন তা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তৃপ্তি বিশ্বাস নিজের নামে গাড়ি কেনার জন্য যে আয়কর সার্টিফিকেট ব্যবহার করেছেন তা-ও ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে, যা আর্থিক গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছেন। গত ৫ মে উপকর কমিশনার কার্যালয় থেকে তৃপ্তি বিশ্বাসকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

তিনি ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া আয়কর আইন, ২০২৩ এর ২৭২ অথবা ২১২ ধারা অনুসারে ২০২৩-২৪ কর বছরের জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেননি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে অতি সম্প্রতি এই বার সিঙ্গারকে বিজয়নগরের হোটেল ঈশা খা এবং কাকরাইলের হোটেল ৭১ এর শিল্পী তালিকা থেকে ব্ল্যাক করা হয়েছে। তাদের বাইরে ব্ল্যাক করা হয়েছে বার সিঙ্গার শ্যামলী আক্তার রুনু ও এইচ এ রূপাকে।

এছাড়াও বার সিঙ্গারদের কারও কারও বিরুদ্ধে কালো টাকার মালিক ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের ব্ল্যাকমেইলিংয়েরও বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বার সিঙ্গার তৃপ্তি বিশ্বাস চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইলিং করতে মধ্যরাতে ওই ব্যবসায়ীর ঢাকার স্বামীবাগের বাসায় যান। যে বাসায় ওই ব্যবসায়ী একাই বসবাস করেন। যার সিসি ফুটেজ পাওয়া গেছে।

আবাসিক হোটেলে মদ ও নাচ গানের আসর বসানো প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল ছাড়া অন্য কোনো হোটেল বা বারে মদের আসর বসিয়ে সেখানে নারীদের দিয়ে নাচ গান করানোর আইনগত সুযোগ নেই। যেসব বার ও হোটেলে অবৈধভাবে এসব কার্যক্রম চলছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

শিগগিরই এই বিষয়ে অভিযান চালানো হবে। ডিবির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, শুধু পাঁচ তারকা হোটেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি আছে দেশি-বিদেশি মদ বিক্রির পাশাপাশি নাচ-গানের অনুষ্ঠান আয়োজনের। এমনকি কোনো তিন তারকা হোটেলেও এই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার কোনো আইনি সুযোগ নেই। যেসব হোটেল ও বারে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চলছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হোটেলগুলোতে পার্টি অ্যারেঞ্জার গ্রুপ বার সিঙ্গার, উপভোগ ট্যুর এবং অন্যান্য অনৈতিক কাজের মাধ্যমে কালো টাকার মালিকদের অর্থ পাচারের যোগসূত্র তৈরি করছে। এজন্য তারা মোটা অঙ্কের টাকাও পান। এরই মধ্যে এই চক্রের কয়েকজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

শেয়ারনিউজ, ১৬ মে ২০২৪

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে