ঢাকা, শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫
Sharenews24

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো কবিরাজের ‘ভয়ংকর’ তথ্য

২০২৫ সেপ্টেম্বর ১২ ১১:৪৯:২৮
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো কবিরাজের ‘ভয়ংকর’ তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: কুমিল্লায় মা-মেয়ে হত্যা মামলার একমাত্র আসামি মোবারক হোসেনের (৩৪) বিরুদ্ধে আগেও একাধিক ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। একটি ঘটনায় আদালতে মামলা হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়। বর্তমানে থানায় কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই। তখন গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে সৌদি আরবে চলে যায় মোবারক। কিছুদিন আগে দেশে ফিরে নতুন করে বর্তমান মাদ্রাসায় যোগ দিয়ে আবার শুরু করেন পুরোনো কুকর্ম।

এদিকে গ্রেপ্তারের পর মে-মেয়ে হত্যাকাণ্ডে নিজের দোষ স্বীকার করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। এ সময় মা-মেয়েকে বালিশচাপা ও গলাটিপে হত্যা করার রোমহষর্ক বর্ণনাও দেন তিনি। এরপর আদালত তাকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে।

এদিকে ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা প্রতিবেদন এসে পৌঁছলেই চার্জশিট দেবে পুলিশ। পুলিশ বলছে, আর কেউ জড়িত নয় এই হত্যাকাণ্ডে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে , ২০২৩ সালের ২৪ জুন কুমিল্লার ধর্মপুর পশ্চিম চৌমুহনীর হজরত খাদিজাতুল কোবরা মহিলা মাদ্রাসা ও এতিমখানায় সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টা করে মোবারক। ধর্ষণে বাধা দেওয়ায় ওই শিক্ষার্থীকে সে সময় ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যাচেষ্টা করে। সে সময় ওই কক্ষে তার কাছ থেকে পানিপড়া নিতে এক নারী এলে সে সুযোগে দৌড়ে পালিয়ে বাঁচে এই শিক্ষার্থী। ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোবারক নিজেই।

ভাড়া নেওয়া ওই মাদ্রাসা এবং বাসাতেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসবাসও করতেন মোবারক। পাশের গলিতে ছিল তার শ্বশুরবাড়ি। ওই ঘটনার দিনই আরেক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে কবিরাজ মোবারক। পরে বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে ঘটনা জানায় ভুক্তভোগী। একই দিনে দুটি ঘটনা ঘটার ফলে দক্ষিণ দুর্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যানকে বিষয়টি জানানো হয়।

তিনি বিচার সালিশে এক লাখ টাকা জরিমানা করে বিষয়টি মীমাংসা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিচারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি পরিবারটি। ২০২৩ সালের ১২ জুলাই কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর পরিবার। এরপর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে পালিয়ে সৌদি আরব চলে যান মোবারক। সৌদি পুলিশের হাতে দুই বছর আটক থাকার পর চলতি বছরের জুলাই মাসে দেশে ফিরে আসে।

ভুক্তভোগী ওই শিশুর মা জানান, মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল কবিরাজ মোবারক। সে সময় এক নারী এসে পড়ায় রক্ষা পায়। আমরা স্থানীয় সালিশে বিচার না পেয়ে মামলা করি। এরপর মামলা উঠানোর জন্য সে ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে। আর ওই অন্য মেয়েটার পরিবারকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে নিজ পরিবার নিয়ে এলাকা থেকে চলে যায় মোবারক।

মোবারকের বর্তমান মাদ্রাসার আশপাশের বাসিন্দারা জানান, প্রায় তিন বছর ধরে মোবারক কবিরাজি পেশায় জড়িত। বদরপুর মাদ্রাসার পীর ইলিয়াস হুজুর বদরপুর মাদ্রাসা ছেড়ে কালিয়াজুরি পিটিআই এলাকায় বাবুস সালাম জমিরিয়া মাদ্রাসা গড়ে তুলেন। দেশে ফিরে হুজুরের খাদেম হিসেবে যোগদেন মোবারক। সেও বদরপুর মাদ্রাসায় কোরআন পড়তে শিখেছে। ৩ সেপ্টেম্বর ইলিয়াস হুজুর ওমরাহ পালনে সৌদি আরব গেছেন। বাসার পাশে বলে ইলিয়াস হুজুরের কাছে জিন তাড়াতে ঝাড়ফুঁক করাতে মেয়েকে নিয়ে আসতেন মা, সেখানেই মোবারকের সঙ্গে তাদের পরিচয়। যার সূত্র ধরে একমাস ধরে খুন হওয়া মা- মেয়ের বাসায় তার যাতায়াত।

মোবারকের পূর্বের ধর্মপুর মাদ্রাসার এক ছাত্রী বলেন, উনি মেয়ে পটানোর কালোজাদু করতেন। উনার চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অনেক রাজনৈতিক নেতারাও আসতেন। তারা উনাকে চালের বস্তা, তেল, চিনি থেকে যাবতীয় কিছু দিতেন মাদ্রাসা চালাতে। এভাবে তিনি সচ্ছল হয়ে উঠেন।

ধর্মপুরে মাদ্রাসা ভাড়া দেওয়া বাসার মালিক হাসিনা বেগম জানান, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অনুরোধে মাদ্রাসা করার জন্য বাসা ভাড়া দিয়েছিলাম। প্রথমদিকে সাহায্য নিয়ে মাদ্রাসা চালাতেন। কিছুদিন পরেই দেখি মাদ্রাসায় সিসি ক্যামেরা, এসি, ফ্রিজ সব হয়ে যায়। নিজের জন্য মোটরসাইকেলও কিনে ফেলেন।

মোবারকের বাড়ি দেবিদ্বার উপজেলার কাবিলপুর গ্রামে। গ্রামবাসী জানায়, নুরানি পর্যন্ত গ্রামের একটি মাদ্রাসায় পড়েছে মোবারক। এরপর বদরপুর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। এখানেই কবিরাজি আয়ত্ত করে। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন না। বদরপুর মাদ্রাসায় পড়াকালীনই ইলিয়াস হুজুরের খাদেম হন।

মোবারকের বড় ভাই মো. সুজন মিয়া জানান, তার ভাই আগে এমন ছিল না। শহরে যাওয়ার পর বিপথগামী হয়েছেন। এর বেশি কিছু জানেন না।

মোবারকের স্ত্রী সুমাইয়ার দাবি, উনি হত্যা করেছেন কিনা জানি না। পুলিশ হত্যার পরে আমার মোবাইল ফোনও নিয়ে গেছে। আমাদের বাবার বাড়ি এলাকায় কুমিল্লা ধর্মপুরে মাদ্রাসা চালাতে গিয়ে মেয়েদের নিয়ে এসব করে জানতে পারার পরে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ছোট দুটি মেয়ে আছে, ওদের দিকে তাকিয়ে তালাক দিইনি।

একজন ধর্ষণচেষ্টা মামলার আসামি কেমন করে এতদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ‘পলাতক’ থাকলো এমন প্রশ্নের জবাবে কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহিনুল ইসলাম বলেন, মামলা অনেক আগের। আদালতে হওয়ায় আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আদালতের কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও নেই। তারপরও অনুসন্ধান চলছে। হত্যা মামলার তদন্তও অব্যাহত আছে।

ভুক্তভোগী ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অ্যাড. হারুনুর রশিদ সবুজ বলেন, ধর্ষণচেষ্টা মামলায় আসামির মোবারকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকেই সে পলাতক ছিল। মামলা এখনও চলছে।

উল্লেখ্য, গত রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) মধ্যরাতে কুমিল্লা নগরীর কালিয়াজুড়ি এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে মা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন–কুমিল্লা নগরীর সুজানগর এলাকার মৃত নুরুল ইসলামের স্ত্রী তাহমিনা বেগম ফাতেমা (৫২) ও তার মেয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন (২৩)।

বাসার নিচতলার স্কুলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, একজন হুজুর ওই বাসায় যাওয়া আসা করেছেন। ওই সূত্র ধরে পুলিশ মোবারককে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মোবারক জিন তাড়াতে গিয়ে মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে মা দেখে ফেলায় তাকে বালিশ চাপায় এবং পরে মেয়েকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করে।

জাহিদ/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে