ঢাকা, সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫
Sharenews24

ব্যাংক রেজুলেশন আইন: ব্যাংক বাঁচাতে আসছে নতুন পদক্ষেপ

২০২৫ মার্চ ১৭ ১০:৩৪:১৮
ব্যাংক রেজুলেশন আইন: ব্যাংক বাঁচাতে আসছে নতুন পদক্ষেপ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে একটি গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকের তালিকায় থাকা ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬টি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও অন্তত ৫টি ব্যাংক এখনও চরম সংকটে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা সুপারিশ করছেন, আমানতকারীদের উচিত ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা যাচাই করে তারপর তাদের আমানত রাখা।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংকেরবোর্ড ভেঙে পুনর্গঠন শুরু করেছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ব্যাংক ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং তারা এখন নিজেরা টিকে থাকতে পারছে। তবে কিছু ব্যাংক এখনও গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ছে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি নাজমুস সাদাত জানিয়েছেন, তাদের ২০০টি শাখা ভালো অবস্থানে থাকলেও, রমজান মাসে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা উত্তোলনের কারণে কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে।

রমজান মাসে বাড়তি কেনাকাটা ও খরচের কারণে ব্যাংকগুলোর ওপর নগদ টাকা তোলার চাপ বেড়ে যায়। সমস্যায় থাকা ব্যাংকগুলো এই বাড়তি চাহিদা মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক সহ ৫টি ব্যাংক এখনও চরম সংকটে রয়েছে। এসব ব্যাংক প্রতিদিন তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নতুন অর্থ সহায়তা প্রদান করছে না। ফলে, গ্রাহকরা এখনও তাদের আমানত উত্তোলনে সমস্যায় পড়ছেন।

বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৪টি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণ গোষ্ঠীগত স্বার্থে দেওয়া হয়েছে, যা এখন আর উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলোর আমানতের ৮০ শতাংশেরও বেশি মাত্র একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত ছিল, যা এখন ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক হিসাবে বলা হচ্ছে, শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা তোলা হয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে, যিনি আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে একাধিক ব্যাংক থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়েছে। গ্রাহকরা আমানত তুলতে সমস্যায় পড়ায় ব্যাংক দুটিকে নতুন করে আড়াই হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সংকট সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে এ সহায়তা দেবে। ১৩ মার্চ গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ অনুমোদন দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম, আর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তার জামাতা বেলাল আহমেদ। আগের সরকারের আমলে এই ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বেরিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এখনও তীব্র সংকটে রয়েছে। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণ গোষ্ঠীগত স্বার্থে দেওয়া হয়েছে, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৪টি ব্যাংকের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়।

ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। নতুন পরিচালনাবোর্ড ও কঠোর নীতির ফলে তারা আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে শুরু করেছে।

দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা ও অবসায়নের প্রক্রিয়া সহজ করতে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন একটি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। সংসদ না থাকায় এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে, যা আগামী জুলাইয়ের মধ্যে কার্যকর হতে পারে।অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যে ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। নতুন অধ্যাদেশ কার্যকর হলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনও দুর্বল ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করতে পারবে। প্রয়োজন হলে ব্যাংকের শেয়ার, সম্পদ ও দায় তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে। নতুন শেয়ারধারকদের মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর নির্দেশ দিতে পারবে। ব্যাংকের মালিকদের অনিয়মের প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠন করতে পারবে, যা সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় গ্রহণ করে পরিচালিত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, এই আইন বাস্তবায়ন হলে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ ও পুনঃমূলধনীকরণ সহজ হবে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, সব ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে না। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক একক গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয়েছে, সেগুলো রক্ষা করা কঠিন হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হলে কিছু প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হতে পারে।

আরিফ/

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে