ঢাকা, শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

দুই হাতে টাকা বানাতে বলতেন শেখ হাসিনা: সোহেল তাজ

২০২৪ সেপ্টেম্বর ২৮ ০৭:০১:৫৯
দুই হাতে টাকা বানাতে বলতেন শেখ হাসিনা: সোহেল তাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল বলেছেন, শেখ হাসিনাকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। যদিও অনেকে আমাকে বলেছেন, হাসিনা কখনো তাজউদ্দীন আহমদের ছেলেকে ভালো চোখে দেখবেন না।

তিনি বলেন, একদিন দেখলাম আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাকে সবার সামনে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘বিএনপি অনেক টাকা বানিয়েছে। এখন আমাদেরও দুই হাতে টাকা বানাতে হবে।’ এটা শোনার পর তাঁর প্রতি আর বিন্দুমাত্র রেসপেক্ট থাকেনি।

সোহেল তাজ দৈনিক কালের কন্ঠের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ তথ্য জানান।

রাজনীতি আসা সম্পর্কে সাহসী কথা বলা এ রাজনীতিক বলেন, অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম। আমেরিকায় লেখাপড়া করেছি। সেখানেই আমার সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। কিন্তু ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে ভেতর থেকে তাগিদ পেলাম, ‘দেশের জন্য কিছু করা দরকার। দেশে ফিরে অনেক বাধা পেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্বাচন করি।;

তিনি বলেন, ২০০১ সালে যখন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়, তখনো নির্বাচিত হয়েছিলাম। নৌকা নিয়ে বিজয়ী ৫৮ সিটের মধ্যে আমার একটি ছিল। সব মিলিয়ে আমার যাত্রাটাই শুরু হয় বিরোধীদলীয় রাজনীতি দিয়ে।

সোহেল তাজ অভিযোগ করে বলেন, বিরোধী দলে থাকাকালে অনেক নির্যাতিত হয়েছি, পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছি, আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছি। এক-এগারোর পর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। ১৯৭১ সালে যে লক্ষ্য সামনে রেখে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের রূপরেখা ছিল এই ইশতেহার, যা আমাকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করে। দেশের জন্য ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল।

তিনি মনে করেন পুলিশ বাহিনীকে সংস্কার করে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখলাম, দিনবদলের সনদ ছিল ভাঁওতাবাজি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেখলাম অদৃশ্য কিছু শক্তি এসে ম্যানুপুলেশনের চেষ্টা করছে। মিটিংয়ে বলেছিলাম, আজ থেকে সব বদলি বাণিজ্য বন্ধ! পুলিশ সংস্কারেরও উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার পথে নানা বাধা সৃষ্টি করা হয়।

বিডিআর হত্যাকান্ড প্রসংগে সোহেল তাজ বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সময় মেয়ের জন্মদিন উদযাপনে আমি আমেরিকা ছিলাম। ১৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা চলে যাই। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর হত্যাকাণ্ডকালে এক আত্মীয়ের মারফত জানতে পারি, পিলখানায় গোলাগুলি হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলাম তৎকালীন আইজি নুর মোহাম্মদকে। পরিস্থিতি শুনে রেসকিউ ফোর্স পাঠাতে বললাম। পুলিশ, র‌্যাবসহ সব ফোর্সকে গেদার করার অনুরোধ করলাম। আইজি বললেন, এ রকম কোনো নির্দেশনা পাইনি। এখানে মন্ত্রী মহোদয় আছেন। তাঁর মানে আমি প্রতিমন্ত্রী, ওখানে মন্ত্রী আছেন। আমি বুঝলাম, আইজি আমার ইনস্ট্রাকশন ফলো করতে পারছেন না। ফোন করলাম মন্ত্রী মহোদয়কে। উনি বললেন, বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী দেখছেন! তাৎক্ষণিকভাবে আমি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে একই কথা বললাম! তিনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমেরিকায় বসে এত বোঝার দরকার নেই, আমি দেখছি।’

তিনি বলেন, আমাকে ঘিরে বিডিআর ইস্যুতে একটা অপপ্রচার চলে, আমি নাকি হত্যাকারীদের পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছি! প্রশ্ন করতে চাই, কিভাবে করলাম সেটা? হত্যাকারীরা কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিল? আমি তো দেশে এসেছি ১০ মার্চ।

সোহেল তাজ আরও বলেন, ঘটনার অনুসন্ধানে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বিডিআর ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু আমাদের হাত থেকে সব কিছু সরিয়ে নিয়ে কোঅর্ডিনেটিং ফরম্যাট করে দেওয়া হলো! কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেওয়া হলো তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানকে। তাঁরাই সমস্ত কিছু তদন্তের দায়িত্ব নিলেন। আমাদের কোনো কিছুতে ইনভলভ রাখা হয়নি। এটাও আমার কাছে খটকা লেগেছে।

প্রতিমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ প্রসংগে সোহেল তাজ বলেন, আমি ৩১ মে প্রধানমন্ত্রীর হাতে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। সংবিধানের ৫৭ ধারা অনুযায়ী একজন মন্ত্রী যখন পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করবেন তখনই পদত্যাগ চূড়ান্ত হয়ে যায়। উনি পদত্যাগপত্র নিতে চাইছিলেন না। আমেরিকা গিয়ে সেখান থেকেই তাঁকে ফোনে বললাম, আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও কার্যকর করুন।’

তিনি বলেন, তখন আমাকে নানা অফার করা হয়েছে, দলীয় পদ-পদবি দিতে চাইলেন। রাজি হইনি। এক পর্যায়ে ফোনেই উনি গান গাওয়া শুরু করলেন। আমি হতবাক হয়ে যাই। গানটা ছিল এমন—‘আমি কাউকে ছাড়ি না, আমি তোমাকে ছাড়ব না।’ এই গান তিনি দুই মিনিট ধরে রিপিট করলেন। বুঝে উঠতে পারছিলাম না দেশের প্রধানমন্ত্রী ফোনে গান গাইছেন আবার গানের সুর এ রকম—আমি তোমাকে ছাড়ব না, আমি কাউকে ছাড়ি না! কি ভয়ংকর অবস্থা! তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাহেবের একটা ডায়ালগ মনে পড়ল, ‘বাঘে ধরলেও ছাড়ে; শেখ হাসিনা যারে ধরে তারে ছাড়ে না!’ শেখ হাসিনার এই থ্রেট আমি কিভাবে গ্রহণ করব, তা বুঝতে পারছিলাম না। এটা ভয়াবহ একটা ব্যাপার ছিল। এরপর কার্যত দুই-তিন বছর আর আমি দেশে ফিরিনি!

সোহেল তাজ জানান, পরবর্তী সময়ে আমি বাধ্য হলাম সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করতে। সব মিলিয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি সংসদ সদস্য ছিলাম। তখন আমি যেটা দেখেছি, দলকে পরিচালনা করেছে ডিজিএফআই। দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের রিপোর্ট করতে হতো ডিজিএফআইয়ের কাছে। এটা আমাকে হতাশ করেছিল। একটা গণতান্ত্রিক দল, যে দল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই দল পরিচালিত হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা। এই দলের তো আর কিছুই রইল না তাহলে।

রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া প্রসংগে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে মূলত সরে গেছি, কারণ—আমি যে আওয়ামী লীগকে জানতাম, চিনতাম, যে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমি ইতিহাসে পড়েছি। সেই আওয়ামী লীগ এবং বর্তমানের আওয়ামী লীগের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দেশের আপামর জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ছিল? আজ যে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করেছে এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যেখানে সাম্য থাকবে, মানবাধিকার থাকবে, মেধাভিত্তিক সমাজ, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিরাপদে বাস করবে, সবার বাকস্বাধীনতা থাকবে, একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে। সেই বাংলাদেশের জন্যই কিন্তু আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। সেটাই ছিল আওয়ামী লীগের সত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগ আজ রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। সুবিধাবাদী-লোভীরা ধনসম্পদ বানানোর জন্য এই সংগঠনটাকে তছনছ করে ফেলেছে।

সোহেল তাজ বলেন, এই যে হত্যা, গুম, খুন এবং অপরাজনীতি; এই সংস্কৃতিকে একটা আতঙ্কে পরিণত করা হয়েছিল যে ‘মানুষ গুম হয়ে যায়, মানুষ নাই হয়ে যায়’। আমার নিজের ভাগিনাকে ১১ দিন আয়নাঘরে আটকে রেখেছিল। তখন আয়নাঘর নামটা আমরা জানতাম না। ব্যক্তিগত ঘটনায় একটা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যের মাধ্যমে প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে আমার ভাগিনাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এটা চিন্তা করা যায়! রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যক্তিগত কাজে! এই বাংলাদেশ আমরা কোনো দিন চাইনি।

সোহেল তাজ বলেন, নির্বাচন হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। সেটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। গত তিনটা নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি মানুষ। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন নির্বাচন। যেখানে ১৫১ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন ছিল রাতের ভোটের নির্বাচন। সর্বশেষ নির্বাচন ছিল ডামির নির্বাচন। এটা তো বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা! আওয়ামী লীগ নামধারী এই রাক্ষস দল হত্যা, খুন, গুম, কায়েম করেছে। শেখ হাসিনা নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছেন, লুট করেছেন, দুর্নীতি করে লাখ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন, গুম-খুন করেছেন। দুই-চারটা ব্রিজ আর মেট্রো রেল দেখিয়ে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছেন। দুর্নীতিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেটা বাংলাদেশে কখনো হয়নি। দেশের বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন। এত এত অন্যায় করেছেন, এটার কি জবাব দিতে হবে না?

সালাউদ্দিন/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে