ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

চার দশকে এই প্রথম আমেরিকা–ইসরায়েল সম্পর্কে ‘ফাটল’

২০২৪ মে ১২ ২০:৫৫:৪১
চার দশকে এই প্রথম আমেরিকা–ইসরায়েল সম্পর্কে ‘ফাটল’

ডেস্ক রিপোর্ট : চলতি সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পর্ককে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। সম্প্রতি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক সাক্ষাৎকারে বাইডেনের কাছে জানতে চেয়েছিল, ইসরায়েল যদি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাফাহ আক্রমণ করে, তাহলে কী হবে? জবাবে বাইডেন বলেন, ‘আমি তাদেরকে আর অস্ত্র সরবরাহ করব না।’

আমেরিকা ইসরায়েল মৈত্রীর ভিত্তিই হলো অস্ত্রের চালান। গত চার দশকে এই প্রথম এতে ফাটল দেখা যাচ্ছে। গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি ও মানবিক বিপর্যয় রুখতে নিজ দেশে ও দেশের বাহিরে ব্যাপক চাপে আছেন বাইডেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটিই জানালেন।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল আমেরিকার সবচেয়ে কাছের কৌশলগত মিত্র। ১৯৮০ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের পর এই ধরনের পদক্ষেপ আর দেখা যায়নি। রাফাহ শহরে অভিযান চালালে ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবে না আমেরিকারাফাহ শহরে অভিযান চালালে ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবে না আমেরিকা

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রাক্তন বিশেষজ্ঞ এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী অ্যারন ডেভিড মিলারের মতে, বাইডেন সংঘাতের শুরু থেকেই দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন।

একদিকে তার ইসরায়েলপন্থী রিপাবলিকান পার্টি এবং অন্যদিকে তার নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত, বাইডেন যে সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছেন তা মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষতি করেনি বলে মনে হয়েছে।

কিন্তু ইসরায়েল রাফাহতে স্থল অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন দেখা যায়। গত সোমবার ইসরায়েল জানায়, তারা শহরটির পূর্বে হামাসকে লক্ষ্য করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্থানীয়রা বিরামহীন বিষ্ফোরণের শব্দ শোনার কথা জানাচ্ছেন।

একই সঙ্গে প্রায় অকার্যকর হাসপাতালগুলোতেও আহতদের সংখ্যা মাত্রা ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, প্রায় এক লাখ মানুষ ওই এলাকা থেকে পালিয়েছে এবং তারা খাবার, আশ্রয়, পানি ও স্যানিটেশনের ভয়াবহ সংকটে আছে।

প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার শহরটিতে পূর্ণমাত্রায় স্থল অভিযান চালানোর কথা বলছেন, যেখানে প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আছেন। তিনি বলছেন, এখানে লুকিয়ে থাকা হামাসের অবশিষ্ট চার ব্যাটালিয়ন যোদ্ধাকে নিশ্চিহ্ন করতে এই অভিযান জরুরী। যুদ্ধবিরতির কোনো প্রস্তাব সফল হলেও অভিযান চালানো হবে বলে মত তাঁর।

ওয়াশিংটন বারবার নেতানিয়াহুকে রাফাতে কোনো সামরিক অভিযান না চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। অ্যারন ডেভিড মিলারের মতে, প্রেসিডেন্ট বিডেন আশঙ্কা করছেন যে রাফাহ অভিযান চালানো হলে যুদ্ধ শেষ করা বা জিম্মিদের উদ্ধারের কোনো উপায় থাকবে না।

বিডেন প্রশাসনে কাজ করা একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা বলেছেন যে বিডেন মিশরের সাথে কোনও সংকট এড়াতে চান। একই সময়ে, প্রচারণা ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ক্ষোভ এবং বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। গত বুধবার বাইডেনের সাক্ষাৎকার প্রচারের পরপর আমেরিকা ইসরায়েলের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার ও ৫০০ পাউন্ডের বোমার দুটি চালান স্থগিত করেছে। মার্কিন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কমকর্তা বলেন, এই বোমাগুলো ঘনবসতিপূরর্ণ একটি এলাকায় ব্যবহার করলে যে প্রভাব পড়বে তাতে আমেরিকা উদ্বিগ্ন, যা আমরা গাজার অন্য এলাকাগুলোতে দেখেছি।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ইসরাইল রাফাতে হামলা চালালে তা বন্ধ করা হবে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, হামাসকে নির্মূল করতে এই ধরনের অস্ত্র প্রয়োজন। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, জয়েন্ট ডাইরেক্ট অ্যাটাক মিনিশন (জেডিএএম) কিটের একটি চালানও বিবেচনাধীন রয়েছে। এই কিট আনগাইডেড বোমাকে গাইডেড বোমাতে রূপান্তর করতে পারে।

গত শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েল হয়তো গাজা যুদ্ধে কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন সরবরাহকৃত অস্ত্র ব্যবহার করেছে। তবে এটাও বলা হয় যে আমেরিকার কাছে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য নেই। মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রাক্তন আর্টিলারি কর্নেল জো বুকিনো, যিনি পরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক কমান্ড সেন্টকম-এর একজন সিনিয়র অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ইসরায়েলের এখনও যে পরিমাণ গোলাবারুদ রয়েছে, তা দিয়ে রাফাকে ‘গ্রাউন্ড’ করা সম্ভব।

ইসরায়েলকে বছরে ৩.৮০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি কংগ্রেস অস্ত্র ও প্রতিরোধ সরঞ্জামের জন্য আরও ১৭ বিলিয়ন ডলার এর সঙ্গে যুক্ত করেছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মার্কিন প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা পাওয়া দেশ হলো ইসরায়েল।

কর্নেল জো বুকিনোর মতে, রাফাহতে আক্রমণ ঠেকাতে অস্ত্রের যে চালান স্থগিত করা হয়েছে তা নিতান্তই নগণ্য। তিনি বলেন, ‘এটা মার্কিন জনগনকে একটা বোঝ দিতে একটি ছোটখাট রাজনৈতিক খেলা, যারা পরিস্থিতির জন্য উদ্বিগ্ন।’

কারণ যাই হোক, এতে বাইডেন যে রাজনৈতিকভাবে চাপে পড়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকানরা বাইডেনকে তুলোধুনো করছেন। মার্কিন সিনেটর পেট রিকেটস বলেন, ‘আমি মনে করি, এই স্থগিতাদেশ ক্ষোভ তৈরি হওয়ার মতো পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। প্রেসিডেন্টের এমন কাজ করার এখতিয়ার নেই।’

ইসরায়েল তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাফাহতে আক্রমন পরিচালনা করতে চায়, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মিত্র ইসরায়েলকে আমাদের সমর্থন করতে হবে।’

আরেক রিপাবলিকান সিনেটর জন বারাসো বলেন, ‘নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ইসরায়েলের যা খুশি তা করার অধিকার আছে।’

বারাসোর মতে, এই সিদ্ধান্তের ফলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তবে বাইডেনের নিজের দলে কিন্তু এ সিদ্ধান্তকে বেশ ভালোভাবেই স্বাগত জানানো হয়েছে।

সরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, প্রয়োজনে ইসরায়েল ‘একা লড়াই’ করবে।সরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, প্রয়োজনে ইসরায়েল ‘একা লড়াই’ করবে। ছবি: রয়টার্স

ডেমোক্রেটিক সিনেটর ক্রিশ কুনস দুইমাস আগে বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি নাগরিকদের রক্ষা না করে ইসরায়েল যদি রাফাহতে অভিযান চালায় তাহলে যেন তাদের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘গাজা সংঘাত আমাদের যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে তা অত্যন্ত বেদনার। আমরা যারা ইসরায়েলের তীব্র সমর্থক তারাও মানুষের কষ্ট এবং মানবিক বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন।’

ক্রিশ কুনস মনে করেন, নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্রমাগত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যেহেতু ইসরায়েলি সরকার টিকে আছে কিছু অতিজাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির ওপরে এবং তারা গাজায় মানবিক সহযোগিতা ঢুকতে দিতে চায় না। পাশাপাশি পশ্চিম তীর থেকেও ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতে চায়।

কায়রোতে হামাসের সঙ্গে জিম্মি মুক্তির যে আলোচনা চলছিল তা গত সপ্তাহে ভেস্তে যায়। কয়েকজন ইসরায়েলি বিশ্লেষক বাইডেনকে সতর্ক করে বলেছেন যে, তার এ সিদ্ধান্ত জিম্মি মুক্তির মধ্যস্থতায় বাধা তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি রাফাহ আক্রমণ না করতে যে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে এতে হামাস লাভবান হবে।

গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর বাইডেন তেল আবিব সফর করেন এবং নেতানিয়াহুর পাশে নিজের অবস্থানের জানান দেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘৯/১১ এর পর আমরা যে ভুল করেছি তোমরা সেটি থেকে বিরত থাক।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "ফিলিস্তিনের জনগণও অনেক কষ্ট পাচ্ছে এবং সারা বিশ্বের মতো আমরাও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করছি।"

গত বৃহস্পতিবার বাইডেন অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত ঘোষণা করার পর নেতানিয়াহু প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, 'আমাদের যদি এককভাবে লড়াই করতে হয়, আমরা তাই করব। আগেই বলেছি, প্রয়োজনে আমরা নখ দিয়ে লড়াই করব।

নেতানিয়াহুর বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর ক্রিস কুনস বলেন, "তাদের নখ দিয়ে লড়াই করার দরকার নেই।" তাদের আধুনিক অস্ত্রের সাথে লড়াই করা উচিত, অনেক ক্ষেত্রে আমেরিকানদের সাথে যৌথভাবে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো তাদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের এমনভাবে লড়াই করতে হবে যাতে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি বেশি না হয়।' ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি থেকে অনুদ্রিত

শেয়ারনিউজ, ১২ মে ২০২৪

পাঠকের মতামত:

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ খবর

আন্তর্জাতিক - এর সব খবর



রে