ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
Sharenews24

রপ্তানি আয় তলানিতে, ধসে পড়ছে পোশাক খাতের ভাগ্য

২০২৫ নভেম্বর ১৩ ১০:৪৬:৫০
রপ্তানি আয় তলানিতে, ধসে পড়ছে পোশাক খাতের ভাগ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মন্দার মাঝেও রপ্তানি খাত কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছিল। কিন্তু ২০২৫–২৬ অর্থবছরে এসে সেই প্রবৃদ্ধির ধারায় ভাটা পড়েছে। চলতি অর্থবছরের আগস্ট থেকে টানা তিন মাস রপ্তানি আয় কমেছে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, সামগ্রিক আয় কমার প্রধান কারণ দেশের প্রধান রপ্তানি খাত—তৈরি পোশাক শিল্পের দুরবস্থা। শুধু আয়ের পতনই নয়, ক্রেতাদের নতুন অর্ডারও কমে যাচ্ছে।

তিন মাস ধরে আয় কমছে

ইপিবির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের অক্টোবরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৮২ কোটি ৩৮ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমেছিল ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং আগস্টে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) প্রবৃদ্ধি ছিল ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ, কিন্তু চার মাস শেষে (জুলাই–অক্টোবর) মোট প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ২২ শতাংশে।

পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বড় ধাক্কা

অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩০২ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ৩৩০ কোটি ডলার—অর্থাৎ আয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি আদেশও কমেছে ২০ শতাংশ, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৪ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা।

আগস্টে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৩৯২ কোটি ডলারে (আগের বছর ৪০৩ কোটি ডলার), সেপ্টেম্বরে কমে ৩৬৩ কোটি ডলারে (আগের বছর ৩৮০ কোটি ডলার)। পোশাক রপ্তানির পতন তিন মাস ধরেই অব্যাহত।

চামড়া ও প্রকৌশল খাতে আশার আলো

তবে পোশাক খাতের মন্দার মাঝেও চামড়া, প্রকৌশল ও হোমটেক্সটাইল খাতে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে।ইপিবি জানিয়েছে, জুলাই–অক্টোবরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে আয় হয়েছে ৪১৪ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ৩৭২ মিলিয়নের তুলনায় ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেশি।প্রকৌশলজাত পণ্য খাতে আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের ১৬৩ মিলিয়নের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। ইলেকট্রিক্যাল উপকরণ, স্টিল পণ্য ও মোটরযান পার্টসের রপ্তানিই এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক।

পাট, কৃষিপণ্য ও হোমটেক্সটাইল খাতে মিশ্র ফল

পাট ও পাটজাত পণ্যের আয় বেড়েছে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ (২৭৭ মিলিয়ন ডলার), আর হোমটেক্সটাইল খাতে প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ (২৭৯ মিলিয়ন ডলার)।তবে কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৭২ শতাংশ—চলতি চার মাসে আয় হয়েছে ৩৭৯ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছর ছিল ৩৮৫ মিলিয়ন। রপ্তানিকারকদের মতে, ভারত ও ভিয়েতনামের প্রতিযোগিতা এবং পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিই পতনের মূল কারণ।

বৈশ্বিক মন্দা ও অভ্যন্তরীণ সংকটে চাপে রপ্তানি

বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ—২০২০–এর পর সর্বনিম্ন। ইউরোপ ও আমেরিকার খুচরা বাজারে বিক্রি কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদাও কমছে।

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, তৈরি পোশাক খাত একের পর এক সংকটে পড়ছে। ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৮৬ শতাংশ, এবং ২০২৫ সালের এপ্রিলে আবারও শিল্প ও ক্যাপটিভ খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪০ ও ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ হারে। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি আরও জানান, খেলাপি ঋণের হার ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ব্যাংক সুদের হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন বিনিয়োগে অনীহা তৈরি হচ্ছে।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ চীন ও ভারতের আগ্রাসী রপ্তানি। যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত শুল্কের কারণে তারা ইইউ বাজারে কম দামে পণ্য পাঠাচ্ছে, ফলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।

তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও স্থিতিশীলতা আসেনি। শুল্কবৃদ্ধির কারণে পোশাকের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি ব্যাংক দুর্নীতি, উচ্চ সুদহার ও কাস্টমসের জটিলতা শিল্পখাতে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

সামনে অনিশ্চিত সময়

রপ্তানি বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের মূল ভিত্তি। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসের সামান্য ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও অক্টোবরের ধাক্কা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। কৃষিপণ্যে সংকোচন ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা রপ্তানি আয়ে নতুন চাপ সৃষ্টি করছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী আট মাসে বিশ্ববাজারে পুনরুদ্ধার না ঘটলে বার্ষিক রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। সরকারের নির্ধারিত ৬৩ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।

তবে নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী। তাদের মতে, উৎপাদন খরচ কমানো, রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ালে ২০২৬ সালের মধ্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার সম্ভব।

মুসআব/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে