ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

দুদকের জালে ৭০ মন্ত্রী-এমপি-ব্যবসায়ী-আমলা

২০২৪ আগস্ট ৩১ ২২:৫২:২১
দুদকের জালে ৭০ মন্ত্রী-এমপি-ব্যবসায়ী-আমলা

নিজস্ব প্রতিবেদক: এক সময় নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। সরকার পরিবর্তনের পর এখন এটি অনেক কার্যকর প্রতিষ্ঠানে ভাসছে। গত ১৫ বছরে সংস্থাটি যা না করতে পেরেছে, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির হাতে এখন বিশাল কাজের ফর্দ। আওয়ামী সরকারের ৭০ মন্ত্রী, এমপি, আমলা আর সুবিধাভোগী ভিআইপি ব্যবসায়ী এখন প্রতিষ্ঠানটির জালে বন্দী।

অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় বিপুল ধন-সম্পদ এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির অভিযোগে এরই মধ্যে অনেকেই জেল-জরিমানার মুখে পড়েছেন। তবে তাঁদের রেহাই নেই দুদকের খড়্গ থেকেও। ক্ষমতার পালাবদলে অকার্যকর সেই দুদক তার জাত চেনানোর সুযোগে এখন লম্বা তালিকা করে ভিআইপি দুর্নীতিবাজদের ধরতে কাজ সাড়াশি অভিযান শুরু করেছে।

দুদকের জালে এখন যে ৭০ প্রভাবশালী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬৪ জনই সাবেক মন্ত্রী-এমপি। বাকি ছয়জনের মধ্যে তিনজন বহুল আলোচিত-সমালোচিত ব্যবসায়ী, তিনজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা ও আমলা।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দুদক যাদের তদন্তের আওতায় এনেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও এমপি সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ারসহ আরো ৬৩ জন।

তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এই বিষয়ে দুদকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে যেসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে—শুধু সেসব অভিযোগই আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করা হচ্ছে। শতভাগ নিশ্চিত হয়েই অনুসন্ধান করা হচ্ছে। যাতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই মামলা করা সম্ভব হয়। তা না হলে সাধারণ জনগণ আগের মতোই সব লোক দেখানো বলে মনে করবে।’

আলোচিত তিন ব্যবসায়ী

গত ১৫ আগস্ট এস আলম গ্রুপের এস আলম ও ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। এরপর ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় দুদক। সংস্থাটি প্রমাণ পায়, তাঁরা আর্থিক খাত থেকে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা পাচার করেছেন।

দুদক জানায়, এস আলম গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্তসহ ছয়টি ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করেছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৫০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে এই গ্রুপটি। এই অর্থ ব্যাংকটির মোট ঋণের এক-তৃতীয়াংশ।

চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছেন পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তিনি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও পদ্মা ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন।

সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, ‘দরবেশখ্যাত’ সালমান এফ রহমান গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। রপ্তানি করেও ওই টাকা দেশে ফেরত আনেননি। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।

আলোচিত দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও এক আমলা

সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় তার স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারে একটি বাড়ি কিনেছেন হারুন। কিশোরগঞ্জে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’ নামে বিলাসবহুল প্রমোদাগার।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজের সময় তিনি দুর্নীতিবাজদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন। কাজের নামে বেশির ভাগ টাকাই ভাগাভাগি করে লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

৬৪ প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানসহ ৬৪ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। এর মধ্যে গত ১৫ আগস্ট সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ১৭ আগস্ট সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালসহ চার এমপি, ১৮ আগস্ট সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। এর বাইরে ১৯ আগস্ট সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীসহ ৪১ জন মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়।

২০ আগস্ট সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানসহ পাঁচ এমপি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সহকারী (পিয়ন) মো. জাহাঙ্গীর, ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানসহ তিন এমপি, ২৫ আগস্ট সাবেক পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীসহ চার এমপি ও একজন সাবেক আমলা, ২৭ আগস্ট সাবেক দুই এমপি, ২৮ আগস্ট সাবেক মৎস্যমন্ত্রীসহ চার এমপি ও ২৯ আগস্ট সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমসহ দুই এমপির দুর্নীতি অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি।

তালিকায় আরো যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা হলেন, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, দিনাজপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি অসীম কুমার উকিল ও তাঁর স্ত্রী যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অপু উকিল। আছেন সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপপ্রেসসচিব আশরাফুল আলম খোকন, সাবেক সহকারী (পিয়ন) ৪০০ কোটি টাকার মালিক মো. জাহাঙ্গীর, সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এবং সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। তালিকায় আছেন সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, বরিশাল-২ আসনের সাবেক এমপি শাহ আলম তালুকদার, বরগুনা-১ আসনের সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু ও তাঁর ছেলে সুনাম দেবনাথ, গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-৫ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মনসুর রহমান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান।

দুদকের তালিকায় আছেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, দিনাজপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি ইকবালুর রহিম, মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শেখর, সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শফিক।

এর বাইরে রয়েছেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। সাবেক মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ, চৌধুরী ফরিদুল হক, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাজাহান খান, হাছান মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনুর নামও রয়েছে দুদকের এই অনুসন্ধানের তালিকায়।

এএসএম/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে