ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫
Sharenews24

তৌফিকা করিম ছিলেন বিচারাঙ্গনের অঘোষিত ‘নিয়ন্ত্রক’

২০২৪ আগস্ট ২২ ১২:০৮:২৬
তৌফিকা করিম ছিলেন বিচারাঙ্গনের অঘোষিত ‘নিয়ন্ত্রক’

নিজস্ব প্রতিবেদক : আইন অঙ্গনে বিশেষভাবে পরিচিত তৌফিকা করিম। তিনি একজন আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী ও ব্যাংকার। বেশি পরিচিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে। তাদের ঘিরে নানা মুখরোচক গল্পও হতো আড়ালে-আবডালে। এই আনিসুল হকের ছোঁয়ায় তৌফিকা করিম ছিলেন বিচারাঙ্গনের অঘোষিত ‘নিয়ন্ত্রক’।

দেশের উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত সবখানেই বিচরণ ছিল তার। গড়ে তুলেছিলেন বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব সিন্ডিকেট। গুরুত্বপূর্ণ মামলায় প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো রায় করিয়েছেন। জামিন করিয়েছেন অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার দুর্ধর্ষ আসামিদের।

প্রতিটি জেলার জেলা ও দায়রা জজ আদালত, জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একক আধিপত্য ছিল এই নারীর। ফলে মন্ত্রী ও তার বান্ধবী মিলে আদালত অঙ্গনের নিয়োগ ও পদায়নের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত সব আদালতেই জনবল নিয়োগ হয়েছে মন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী। আর নিয়োগপ্রাপ্তদের বেশিরভাগের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা অথবা কুমিল্লা এলাকার। সাব-রেজিস্ট্রার বদলি করেও কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে এই সিন্ডিকেট।

কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ করার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে। এসব নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যের টাকা কালেকশন করেছেন মন্ত্রীর বান্ধবী তৌফিকা করিম, আইন সচিব এবং সাবেক ও বর্তমান দুজন এপিএস। আর মাঠপর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন করেছেন বেশ কয়েকজন আইনজীবী।

স্ত্রী-সন্তানবিহীন সাবেক এই মন্ত্রীর আস্থাভাজন ও ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তৌফিকা করিম। তাকে করা হয় আনিসুল হকের মালিকানাধীন সিটিজেন চার্টার ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও একটি বেসরকারি টিভির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্যসহ বসানো হয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে।

আইনজীবীদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা করদাতা হয়েছেন এই নারী। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও। সাবেক এই মন্ত্রী ও তার বান্ধবী ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও লুটপাট করে দেশ-বিদেশে গড়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গোপন আস্তান থেকে পালানো সময়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন আনিসুল হক। আর তৌফিকা করিম চলে গেছেন আত্মগোপনে। তবে এই নারী দেশ ছেড়ে কানাডায় তার ছেলের কাছে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। সেখানেই রয়েছে তার বিপুল সম্পদ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনিসুল হকের বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন তৌফিকা করিম। সিরাজুল হক মারা যাওয়ার পর তৌফিকা হয়ে যান আনিসুল হকের জুনিয়র।

এরপর ২০১৪ সালে আনিসুল হক আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হলে তৌফিকা করিম লাইমলাইটে আসেন। আনিসুল হকের দীর্ঘ প্রায় এক দশকের মন্ত্রীত্বকালীন সময়ে তৌফিকা করিমের অপ্রতিরোধ্য প্রতাপ দেখা যায়। যে কারণে বিচারাঙ্গনে আনিসুল হক ও তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ ছিল না।

২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীর অধস্তন আদালতে যত নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশেই খাতা পরিবর্তন, জালিয়াতি, পরীক্ষা না দিয়েও চাকরি হওয়ার নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ-বাণিজ্যসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। বিনিময়ে প্রতিটি নিয়োগের বিপরীতে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি (প্রিজন) পার্থ গোপালের বাসায় ৮০ লাখ টাকা পাওয়ায় দুর্নীতির মামলা হয়। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ তার জামিন নামঞ্জুর করেন। মামলার বিচার নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

এরপর ঢাকার ৫নং বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ইকবাল হোসেনকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে পার্থ গোপালকে জামিন দিতে বলা হয়। পরে আদালত গোপনে খাসকামরা থেকে পার্থ গোপালকে জামিন দেন। এই ঘটনা ফাঁস হলে হাইকোর্ট কৈফিয়ত চেয়ে রুলও জারি করা হয়।

এদিকে, ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির দুর্নীতির মামলায় চিশতি পরিবারের জামিনের আবেদন আপিল বিভাগেও নামঞ্জুর হয়। অথচ বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ থেকে জামিনের ব্যবস্থা করানো হয়।

২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি ফুড কোম্পানির কারখানায় ৫১ জন লোক পুড়ে মারা যায়। আরও ৫০ জন পুড়ে গুরুতর জখম হন। বিষয়টি দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ২০২১ সালের ১০ জুলাই অভিযুক্তদের চার দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। পরে রিমান্ড শেষে ১৪ জুলাই দুই আসামিকে আদালত জামিন দিতে বাধ্য হন। ১৯ জুলাই আরও তিন আসামিকে জামিন দিতে বাধ্য হন আদালত।

অভিযোগ রয়েছে, একজন ব্যবসায়ীর মধ্যস্থতায় ওই ফুড কোম্পানির মালিকের সঙ্গে আইনমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন এবং সিটিজেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান তৌফিকা করিমের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করার পর জামিনের ব্যবস্থা করা হয়।

আরও অভিযোগ রয়েছে, ঢাকার বোট ক্লাবের ঘটনায় নায়িকা পরীমণির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া নাসির উদ্দিন ও অন্য এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইন ও মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। ঢাকা কোর্টের রেওয়াজ অনুসারে জেলা জজ ও নারী শিশু ট্রাইব্যুনালে বিচার্য বিষয়ে সিজিএম কোর্ট, অর্থাৎ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট জামিন দেন না।

কিন্তু এই ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রিমান্ড থেকে কোর্টে না পাঠিয়ে আসামিদের একই দিনে জামিন দিতে বাধ্য করা হয়। একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও একজন সাবেক এমপির মধ্যস্থতায় মন্ত্রীর পক্ষে তৌফিকা করিম ২ কোটি টাকা মূল্যের ডলার ও ইউরো বুঝে নেন। এর পরই মন্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটদের জামিন দিতে বাধ্য করা হয়।

দেশে বহুল আলোচিত দুই মামলার রায় পরিবর্তন করেছিলেন আনিসুল ও তৌফিকা জুটি। এর মধ্যে রয়েছে, ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ বনানীর রেইন ট্রিতে সংঘটিত ধর্ষণ মামলার রায়। এই মামলায় প্রধান আসামি ছিলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে সাফাত হোসেন। ২০২১ সালের নভেম্বরে গুলশানের একটি তারকা হোটেলে তৌফিকা করিম বৈঠক করেন দিলদার হোসেন সেলিমের সঙ্গে। তারপরই নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায় মামলার রায়। অর্থের বিনিময়ে আইন মন্ত্রণালয়ে মামলার রায়ের নথি লেখা হয়। এই নথি ২১ নভেম্বর পাঠ করেন বিচারপতি মোসাম্মত কামরুন নাহার।

এ ছাড়া গুলশানের চাঞ্চল্যকর মুনিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় অর্থবাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে আনিসুল ও তার বান্ধবী তৌফিকার বিরুদ্ধে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে এই মামলা থেকে অব্যাহতি পান আসামিরা।

গত মঙ্গলবার মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে প্রভাবিত করা হয়েছে।

মুনিয়ার বড় বোন বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আমি আমার বোন হত্যার বিচার দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ন্যায়বিচার পাইনি। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার বান্ধবী তৌফিকা করিমকে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নিয়ে মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। আমি এসব ব্যাপারে পতিত স্বৈরাচার, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য একাধিকবার আবেদন করি। প্রায় ২৬ পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু তিনি সাক্ষাৎ দেননি।’

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুনিয়া হত্যা মামলার রায় পরিবর্তন, আসামির জামিন, নিয়োগ প্রদানসহ সব ক্ষেত্রে প্রভাব খাটাতেন তৌফিকা করিম। চাঁদাবাজি করতেন সাব-রেজিস্ট্রার অফিস থেকেও।

বিচার ব্যবস্থাকে জিম্মি করে আনিসুল হক ও তৌফিকা করিম হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন। গড়ে তুলছেন সিটিজেন ব্যাংক লিমিটেড। বিনিয়োগ করেছেন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে। আর দুটি প্রতিষ্ঠানেরই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছেন তৌফিকা করিমকে।

অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম আনিসুল হকের সঙ্গে জাতীয় চার নেতা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। আইনমন্ত্রীর কল্যাণে ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল সদ্য পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ‘সেরা দেশীয় বেসরকারি সংস্থা’র সম্মাননা নেন তৌফিকা করিম। আইনজীবীদের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা করদাতাও নির্বাচিত হন তিনি।

মিজান/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে