ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

রোমানিয়ায় তেলাপোকায় আক্রান্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা

২০২৪ এপ্রিল ৩০ ১৭:১৫:২৭
রোমানিয়ায় তেলাপোকায় আক্রান্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা

প্রবাস ডেস্ক : রোমানিয়ায় অভিবাসীরা যে পরিবেশে বাস করে তা দেখে কেউ অবাক হতে পারে! দুই জন লোক থাকার মতো একটি ঘরে বাঙ্কার বিছানায় ছয় থেকে দশ জন লোকের থাকার ব্যবস্থা। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ছারপোকার যন্ত্রণায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঘুমাতে কষ্ট করে।

রোমানিয়ায় নির্মাণ খাতে কাজ করতে আসা একদল বাংলাদেশি শ্রমিক প্রতিশ্রুত বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। কর্মক্ষেত্রে নানা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা। দেশটির রাজধানী বুখারেস্টে শোচনীয় পরিস্থিতিতে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে আছেন এই বাংলাদেশিরা।

বুখারেস্টের একটি একতলা ভবনে প্রায় ৫০ জন দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী শ্রমিক বসবাস করেন। সেখানকার একটি কক্ষের বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহীন। ভালো আয়ের স্বপ্নে সাত লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে ১৩ মাস আগে ইউরোপের দেশ রোমানিয়ায় আসেন তিনি। শাহিন ইনফোমিগ্রেন্টসকে বলেন, নির্মাণ খাতে কাজের জন্য তাকে দেশে আনা হলেও 'সাপ্লায়ার' তাকে একটি কারখানায় কাজ দেয়।

তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ থেকে আসার আগে তাকে তিন হাজার লিউ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শাহীন এখন আড়াই হাজার লিউ বেতন পান। আসার আগে বলা হয়েছিল ট্যাক্সের টাকা কোম্পানি বহন করবে।

কিন্তু আসার পর সেই টাকা তাকে বহন করতে হয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, যে কোম্পানি কর্মী সরবরাহ করে তারা প্রতি মাসে তার বেতন থেকে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা কেটে নেয়। বাকি টাকা পুরো মাস ব্যবহার করতে হবে। কোন চিকিৎসা ভাতা বা অন্য কোন সুবিধা নেই।

শুধু শাহীনই নয়, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন এই ভবনে বসবাসকারী অন্যান্য বাংলাদেশিরাও। গত বছরের মে মাসে আসেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

তিনি আরও বলেন, চুক্তি অনুযায়ী তিন হাজার লিউ পাওয়ার কথা থাকলেও ট্যাক্স কেটে নেওয়ার পর তিনি পেয়েছেন আড়াই হাজার লিউ। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ৮-৯ লাখ টাকা খরচ করেও যদি ৫০ হাজার টাকা আয় করতে না পারেন তাহলে এখান থেকে কোনো লাভ নেই।

অনেক সময় কী কারণে বেতনের টাকা কেটে রাখা হয় নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সেই ব্যাখ্যাটুকুও দেয় না বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। সাত মাস আগে আসা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘কোম্পানি কিছু হলেই চাকরি থেকে বের করে দেয়। না হলে বেতন কেটে রাখে। কেন কাটছে তার কোনো কৈফিয়তও দেয় না।’

কুষ্টিয়া থেকে আসা মোহাম্মদ রাজীব হোসেন বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোম্পানির মাধ্যমে এসেছি। সেই কোম্পানি আরেক কোম্পানির কাছে আমাদের বেঁচে দিয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিল তিন হাজার লিউ পাব। দেওয়া হয় দুই হাজার।’

এমন অবস্থায় বেতনের টাকা দিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে এই অভিবাসীদের। তাই বাড়তি আয়ের জন্য তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি ফুড ডেলিভারি বা ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী খাবার তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। শাহীন বলেন, ‘ফুড ডেলিভারি না করলে বাড়ি থেকে টাকা এনে খেতে হতো।’

এই অভিবাসীরা অভিযোগ করে যে রোমানিয়ায় পৌঁছানোর পরে, তারা যে টিআরসি বা অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়েছিল, তা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তাদের অন্য কোম্পানিতে কাজ করতে বাধা দেয়। এমনকি বেতন বা কাজ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলে নিয়োগকর্তারা তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দেন। এমন পরিস্থিতিতে তারা অন্যায়ের শিকার হয়েও একই কোম্পানিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। শাহীন বলেন, নিয়োগকর্তাদের কাছে অভিযোগ করলে তারা আপনাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। আমরা যে কাজ দেই তা করতে হবে।

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এ নিয়ে কথা বললে কোম্পানি বলে তোমরা থাকলে থাকো না হলে চলে যাও।...টিআরসি কার্ড নিয়ে গেছে ওরা। এনওসি দিচ্ছে না। এনওসি দিলে আমি অন্য কোম্পানিতে যেতে পারবো। না হলে আমাকে অবৈধ হয়ে যেতে হবে।’

এই অভিবাসী জানান, শুরুতে কোম্পানি তাদের পাসপোর্টও জমা নিয়ে নেয়। কিন্তু পরে সবাই মিলে আন্দোলনের পর পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়েছে।

ইউরোপের একটি দেশে এই অভিবাসীরা যে পরিবেশে থাকেন তা দেখে যে কেউ অবাক হতে পারেন। বড়জোর দুই জনের থাকার মতো একটি কক্ষে বাঙ্কার বেডে ছয় থেকে দশ জনও থাকেন সেখানে। ঘিঞ্জি ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে আছে ছারপোকার যন্ত্রণা, যার কারণে ঘুমানোই কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানান তারা।

সেখানে শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় অভিবাসীরাও রয়েছে। তাদের অবস্থাও একই। তাদের কেউ কেউ কর্মক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার করুণ অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। মোহাম্মদ শরীফ নামে একজন ভারতীয় বলেছেন, 'আমি যে অবস্থায় আছি তা দেখুন। আমাদের থাকার জায়গা, রান্নাঘরের অবস্থা দেখুন। ইউরোপে যে সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তার কোনোটাই নেই। ভারতে যে চাকরির কথা বলা হয়েছে বা যে বেতন বলা হয়েছে তা এখানে মেলে না।'

এই অভিবাসীদের কেউই রোমানিয়াতে এই পরিস্থিতিতে থাকবেন না বলে আশা করা হচ্ছে। প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখেছিল যে তাদের কর্মক্ষেত্রে যথাযথ অধিকার থাকবে, ইউরোপীয় দেশগুলিতে ন্যূনতম জীবনযাত্রার সুবিধা থাকবে। নিয়মিত বা বৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ আনার পরও এমন পরিস্থিতির কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন।

সাইফুল বলেন, ‘আমি ওমানে ছিলাম, দুবাইতে ছিলাম। আমার মনে হয় আরব গালফে ভালো ছিলাম। ইউরোপে এসেছিলাম বেশি টাকার জন্য। প্রত্যাশা করেছিলাম ভালো পজিশন পাব, সুযোগ সুবিধা ভালো পাব। কিন্তু এখানে তো এসে দেখি কিছুই নাই।’

গত কয়েক বছরে অনেক বাংলাদেশি ওয়ার্ক ভিসা নিয়ে রোমানিয়ায় এসেছেন। তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় সীমান্ত পেরিয়ে অনিয়মিত রুট দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে প্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। অভিবাসীদের অভিযোগ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না পাওয়ায় অনেকেই এই পথ বেছে নেন।

কিন্তু রোমানিয়ায় এসে ভালো বেতন ও সুবিধা নিয়ে কাজ করার উদাহরণও রয়েছে। মোহাম্মদ মুকুল নামে এক অভিবাসী বলেন, রোমানিয়ায় ভালো কোম্পানি রয়েছে। খারাপ কোম্পানিও আছে। অনেক কোম্পানি আছে যাদের টিআরসি জমা দিতে হয় না।

শেয়ারবাজার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

পাঠকের মতামত:

প্রবাস এর সর্বশেষ খবর

প্রবাস - এর সব খবর



রে