ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪
Sharenews24

অজ্ঞাত স্থান থেকে হারুন: ‘আগেতো আমাকে বাঁচতে হবে’

২০২৪ অক্টোবর ০৯ ২৩:১১:৪৩
অজ্ঞাত স্থান থেকে হারুন: ‘আগেতো আমাকে বাঁচতে হবে’

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ। পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম। প্রভাবশালী এ কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই তুমুল আলোচনায়।

গত ০৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদকে ঘিরে নানা তথ্য ছড়াতে থাকে। যার মধ্যে বিমানবন্দরে তার ওপর ছাত্রদের হামলা, সিএমএইচে ভর্তি, অন্য বাহিনীর হেফাজতে থাকা, আর সর্বশেষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়া।

তবে নানা গুজব এবং আলোচনা-সমালোচনার মাঝেও হারুনের অবস্থান এখনো অজানা। অজ্ঞাত স্থান থেকেই সম্প্রতি প্রবাসী এক সাংবাদিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেছেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বর্তমান অবস্থান ও কাজে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘আমাকে ঘিরে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। তখনো আমি চুপ ছিলাম।’

সাবেক ডিবি প্রধান বলেন, ‘সরকার যখন বলল, সবাইকে কাজে যোগ দিতে। তখন আমি গত ৮ আগস্ট ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে তখনই যোগ দিতে নিষেধ করেন। আমাকে নিরাপদ স্থানে থাকতে বলেন।’

তিনি বলেন, ‘আমি যোগদান করতে গেছি। কিন্তু আমি যোগ দিতে পারিনি। দুই দিন পর দেখি আমার নামে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। যেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, কমিশনার ও আমাকে হুকুমের আসামি করা হয়। তখন আমি অবাক হলাম।

হারুন বলেন, ‘আমি তো ডিবিতে কাজ করি। ডিবির কাজ হলো মামলা তদন্ত করা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দিলে আমরা গ্রেপ্তার করি। মোহাম্মদপুরে তো আমি গিয়ে মারামারি করিনি, এটা তো আমার কাজ না। অতিরিক্ত কমিশনার কি মারামারি করতে যায়? আর ডিএমপিতে কমিশনারের পরে ৬ জন অতিরিক্ত কমিশনার। আমি হলাম ৬ নম্বর কমিশনার। সেখানে আমার নামে যখন মামলা হলো তখন তো একটু…। আবার বলা হলো মামলা হলেও সমস্যা নেই। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলে গ্রেপ্তার করা হবে না। আমি মনে করলাম ভালো কথা। ভাবলাম জয়েন করব।’

তিনি বলেন, ‘পরের দিন দেখলাম একজন উপদেষ্টা বললেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জয়েন করেননি আপনারা তাদের ধরে নিয়ে আসেন। আমি তখন আরো অবাক হলাম। আমি ‍যদি চাকরিতে জয়েন না করি তাহলে প্রসিডিং করবে। আর যোগ দিলে আমাকে দিয়ে জোর করে চাকরি করাবেন। এটা শোনার পরে আমার মনে হলো রিস্ক। মানে আমার লাইফ ঝুঁকির মধ্যে। এখন মানুষকে ধরে যেভাবে পেটানো, ডিম মারা হচ্ছে। যদি আমাকে…। আগে তো বাঁচতে হবে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে একটু চুপ আছি।’

ছাত্র-জনতার হাতে গণধোলাইয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবে নানা গুজব আছে। আপনারা মরার ছবিসহ নানা গুজব দেখেছেন। আমি এগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। যারা এগুলো বলে তারা টাকা-পয়সা পাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়ে। এগুলো গুজব।’ পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার বিষয়ে সাবেক ডিবি প্রধান বলেন, ‘আমি পুলিশ সদর দপ্তরে যাইনি।’

হাউন আঙ্কেলের ভাতের হোটেলের প্রবর্তক পুলিশের বহুরূপী এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আমেরিকা এসেছিলাম ছুটি নিয়ে। জুলাইয়ের ১৫ তারিখ দেশে ফিরি। দেশে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোর কমিটির বাসায় একটা মিটিং হয়। প্রতিদিন সেই মিটিং হতো। মিটিংয়ে স্বরাষ্ট্রসচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, এনএসআই, ডিজিএফআই, এসবি, বিজিবিপ্রধান ছিল। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও এনটিএমসির প্রধান। প্রতিদিন কোর কমিটির মিটিং হচ্ছিল। একদিন মিটিংয়ে আমাকে ডাকা হলো। আমার কাছে গ্রেপ্তারের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়। তখন আমি বলি আমার কাছে কেউ গ্রেপ্তার নেই। তবে র‌্যাব নুরুকে গ্রেপ্তার করে আমার কাছে দিয়েছে, নজরুল ইসলাম খানকে দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে তিনজন সমন্বয়ক আছে। তাদের এসবি পাহারা দিচ্ছিল। আমাকে বলা হলো তাদের নিরাপত্তার জন্য ডিবিতে আনার জন্য। তখন বলি আমি তাদের কিভাবে নেব?’ বিভিন্ন জেলা এসপি থাকা অবস্থায় নানা কারণে আলোচনায় থাকা পুলিশের পদস্থ এ কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘তখন তারা বলে এত কিছু বোঝার দরকার নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব আপনি নিয়ে রাখেন। আমাকে কমিশনারসহ কোর কমিটির সবাই এই কথা বলেছে। এরপর আমি ডিবির রমনা বিভাগের ডিসি হুমায়ুনকে সমন্বয়ক তিনজনকে নিয়ে আসতে বলি। হুমায়ুন তাদের নিতে আসে। তাদের মোবাইল আগেই ডিজিএফআই নিয়ে গেছিল। রাত ২টা-৩টার দিকে আমাকে ডিজিএফআইয়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন দিয়ে বলেন সারজিসসহ আরো দুজনকে ডিবি গেটে আনা হয়েছে। আপনার কোনো এক কর্মকর্তাকে বলেন রিসিভ করতে। পরে আমি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহেনশাহ মাহমুদকে ফোন দিয়ে বলি রিসিভ করতে। পরে তাদের সাইবারের একজন এডিসি রিসিভ করে। এই হলো পাঁচজন। পরের দিন ডিজিএফআইপ্রধান আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, একটি মেয়ে (নুসরাত তাবাসসুম) খুব উৎপাত করছে তাকেও তুলে আনতে হবে। আমি মিরপুরের ডিসি মানস কুমার পোদ্দারকে বলি তাকে আনতে। এই ছয়জন হলো। এরপর আমাকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী পুলিশ হাসপাতালে যাওয়ার পরে আমার কাছে কাজের আপডেট জানতে চান এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলাম। আমি বিস্তারিত তাকে পাঠাই। আগে তাদের বিভিন্ন সংস্থা মারধর করেছে। কিন্তু আমি তাদের (সমন্বয়ক) স্বজনদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিয়েছি। আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আমি ভাতও খেয়েছি। ওই মেয়েটার মাকে এনে তার সঙ্গে রাখা হয়েছে। এর আগে আরেকটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল আইনসচিবের সঙ্গে আমার কথার। আমি আইনসচিবকে বলি আমি তাদের ধরিনি। কিন্তু আমাকে কালার করা হচ্ছে। তখন কিন্তু বিভিন্ন মিডিয়ায় আসছিল তাদের ডিবিতে আটকে রাখা হয়েছে। আমি তো কোনো কূলই পাচ্ছি না। সাধারণ মানুষ জানতেছে তাদের আমি আটকে রেখেছি। আমি হারুন তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ কথা বলিনি। ভিপি নুরের সঙ্গেও দুজন সমন্বয়কের কথা বলিয়ে দিয়েছি। তারা যাওয়ার পরে কিন্তু এখন পর্যন্ত বলেনি হারুন তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার ক্ষতিটা হলো মানুষ জানল হারুন তাদের ধরে নিয়েছে।’

পুলিশের ডিবি ইউনিটের কর্মকান্ড সববেশি সমালোচনা হয়েছে যার আমলে তিনি হলেন হারুন। তার আমলে সবার নজর ছিল ডিবির দিকে। সেই ডিবির কর্মকান্ড নিয়ে হারুন বলেন, ‘এখনো তো সব গ্রেপ্তার ডিবি করছে। সারা দেশে ধরা হচ্ছে তাদের তো ডিবিতে নেওয়া হচ্ছে। আমি ডিবিকে মানুষের আস্থার স্থানে নিয়ে এসেছি। বিএনপি যত নেতাকে গ্রেপ্তার করে ডিবিতে এনেছি। কেউ বলতে পারবে না কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি কখনো খারাপ ব্যবহার করিনি। মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যার ঘটনায় ৩৩ জন দলীয় নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছি। এতে দলের নেতারা ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সর্বশেষ এমপি আনার হত্যার ঘটনায় নেপাল, ভারত এমনকি পাহাড় থেকে আসামি ধরে এনেছি। জেলার সাধারণ সম্পাদককে ধরেছি। তার মানে কোনো ঘটনা ঘটলে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে জড়াইনি। আমার এমন কাজে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনেকে ক্ষিপ্ত হয়েছে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে বিপদে ফেলে পালিয়ে ভারত চলে গেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর হিসাবে পরিচিত ডিবির সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি ছোট মানুষ। আমি ডিএমপির প্রধানও না, পুলিশের প্রধান না। আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমাকে মোয়া বানানো হচ্ছে। আমি কেন আলোচিত-এর একটাই কারণ যেখানে অপরাধ হয়েছে সেখানে আমি মানুষকে সেবা দিয়েছি। মানুষ যখন যে সমস্যায় পড়েছে তারা থানায় না গিয়ে ডিবিতে আসত। ডিবিতে আমার চাকরিজীবনে মানুষের উপকার করেছি। কারো ক্ষতি করিনি।’

হারুন সব সময় সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি অনুতপ্ত কি না জানতে চাইলে হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘আমি লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করিনি। আমি সরকারি চাকরি করি। আমার সঙ্গে কোনো দিন শেখ হাসিনার দেখা হয়নি। ১৫ বছরের ক্ষমতাকালীন সময়ে কোনো দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। আমার সঙ্গে কথা হয়নি। আমাকে বলা হচ্ছে হুকুমদাতা। আমি হুকুমদাতা কিভাবে হলাম। আমি তো ডিএমপি কমিশনারের অধীনে কাজ করেছি। আমি যা করেছি ন্যায়বোধ থেকে করেছি। অন্যায় করিনি। ন্যায়বোধ দিয়ে কাজ করায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েছি। কিন্তু মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছে। আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ নেই।’

মামুন/

পাঠকের মতামত:

জাতীয় এর সর্বশেষ খবর

জাতীয় - এর সব খবর



রে