ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

৩৬ বছরের চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখিনি : গভর্নর

২০২৩ নভেম্বর ০৭ ০৯:৫০:০৮
৩৬ বছরের চাকরী জীবনে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখিনি : গভর্নর

নিজস্ব প্রতিবেদক : আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। বলেছেন, ‘আমার ৩৬ বছরের সিভিল ও পাবলিক সার্ভিসে আমি কখনোই এত বড় অর্থনৈতিক সংকট দেখিনি।’ গতকাল সোমবার অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) নেতাদের সঙ্গে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সময় জাতীয় নির্বাচনের পর অর্থনীতি স্থিতিশীলতা ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী যে স্থিতিশীলতা আসবে তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে। তাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়বে। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎস থেকেও বাড়তি অর্থায়ন সুবিধা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ এখন একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। আর নিচে নামার সুযোগ নেই। এখন ওপরের দিকে উঠতে হবে। ফলে আগামী ডিসেম্বরেই মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করবে। ডিসেম্বরে এ হার কমে ৮ শতাংশে নামতে পারে। চলতি অর্থবছরের শেষদিকে তা ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। এছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে এ চাপও কমে আসবে।

টাকা পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, হুন্ডির চেয়ে ব্যবসার আড়ালে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার হয়। পাচারের অর্থে দুবাইতে ১৩ হাজার বাংলাদেশি কোম্পানি গঠন করেছেন। আর পর্তুগালে আড়াই হাজার কোম্পানি গঠন করেছেন বাংলাদেশিরা। এসব কোম্পানি গঠন করা হয়েছে পাচার করা অর্থে। দেশ থেকে আগে প্রতিমাসে প্রায় ১৫০ কোটি ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো। কঠোর তদারকির ফলে এখন তা কমে এসেছে। বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নতুন করে আর কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। নতুন কোনো তহবিলও গঠন করা হবে না। আগে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে বা তহবিল গঠন করা হয়েছে সেগুলো থেকে আদায়ের মাধ্যমে ঋণের স্থিতি বা তহবিলের আকার ছোট করে আনা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে আগে যে অস্থিরতা ছিল, তা অনেকটা কমে গেছে। আগামীতে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আব্দুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেন যে পণ্যমূল্য বাড়ানোর নেপথ্যে সিন্ডিকেট হচ্ছে। সেজন্য অযৌক্তিকভাবে কোনো কোনো পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সেগুলোর দামও বাড়ছে। সেজন্য মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ডলার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। এর মাধ্যমে ডলারের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, আগামী ডিসেম্বরে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে। ঋণ চুক্তি হওয়ায় এ ঋণ পাওয়া নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই।

অর্থনীতিতে ত্রিমাত্রিক ঘাটতি- ইআরএফের সাথে মতবিনিময় সভায় গভর্নর বলেন, “আমরা সব সময় জোড়া ঘাটতি নিয়ে আলোচনা করেছি – চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং রাজস্ব ঘাটতি। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং আর্থিক হিসাবের ঘাটতি উভয়ই দেখা গেছে, গত ১৪/১৫ বছরে ঘটেনি। আর্থিক অ্যাকাউন্টটি আগের অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত থেকে চলতি অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ঘাটতিতে পড়েছে। অর্থাৎ ১৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ব্যবধান। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ব্যাপক মাত্রার পরিবর্তন আর দেখা যায়নি।”

তিনি বলেন, আগের অর্থবছরের ১২ জুলাই গভর্নর পদ গ্রহণ করার পর, আমি উত্তরাধিকার সূত্রে ১৮ বিলিয়ন ডলারের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি পেয়েছি, যা জিডিপির ৪ শতাংম। উল্লেখযোগ্যভাবে, আমরা সফলভাবে এই ঘাটতিকে ইতিবাচক ভারসাম্যে পরিণত করেছে। তবে, আমরা আর্থিক অ্যাকাউন্টের নেতিবাচক অঞ্চলের দিকে মোড় নেওয়ার কারণে সতর্ক হয়ে পড়েছিলাম। এই অপ্রত্যাশিত উন্নয়ন একটি নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করেছে যা আমরা আশা করিনি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে দ্বিধা বোধ করায় বিদেশী সরাসরি বিনিয়োগ শূন্যের কাছাকাছি নেমে এসেছে। উপরন্তু, স্বল্পমেয়াদী ক্রেডিট এবং ট্রেড ক্রেডিটও প্রতিকূল, এবং আমাদের বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় তিন বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আবদুর রউফ বলেন, এই চারটি বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা আমাদেরকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

অর্থ পাচারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি- তিনি স্বীকার করেন যে মানি লন্ডারিং, বিশেষ করে বাণিজ্য-ভিত্তিক খুব গুরুতর রূপ নিয়েছে। দিনি বলেন, হুন্ডির চেয়ে ওভার-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কমপক্ষে ১০ গুণ বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। আমরা দেখেছি যে ১০০ ডলার মূল্যের পণ্য আমদানির জন্য ৩০০ ডলারের একটি এলসি খোলা হয়েছে, ২০ ডলার মূল্যের পণ্য কেনার জন্য ৪০ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এতে এভাবেই দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে গেছে।

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, দুবাইয়ে ১৩ হাজার বাংলাদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে। প্রতিটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে দুবাইতে। পর্তুগালে গত দুই বছরে আড়াই হাজার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে ৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করতে হয়েছিল। এই টাকাও দেশের বাইরে পাচার হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আগে প্রতিমাসে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হতো। পরবর্তী সময়ে নজরদারি বাড়ানো হয়। এজন্য এলসি বিল ৮ থেকে ৯ বিলিয়নের স্থলে ৪ থেকে ৫ বিলিয়নের ঘরে নেমেছে। এতে কিন্তু পণ্যের সরবরাহ কমেনি। তবে ডলারের প্রবাহ বাড়লে এলসি খোলার বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হবে।

খেলাপী ঋণে নাজুক পরিস্থিতি- আব্দুর রউফ স্বীকার করেন যে ব্যাংকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এ পরিস্থিতি বেশ নাজুক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, “আমি গভর্নর হওয়ার পর, আমি ঋণ পুনর্নির্ধারণের একটি সীমা আরোপ করেছিলাম। আগে, কোনো ডাউন পেমেন্ট ছাড়াই ৫/৬ বার ঋণ পুনঃনির্ধারণ করা যেত। আমি এটি চারবারে সীমিত করেছি। কোনো ঋণ চারবারের বেশি পুনঃতফসিল করা যাবে না। এর পর তা নন-পারফর্মিং লোনে পরিণত হবে এবং ব্যাংক মামলা করবে। সে কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ ব্যাপারে আমরা খুবই কঠোর।” তবে নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইনের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপী ঋণ কমাতে নানামুখী ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি বলেন, ঋণ খেলাপী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এখন থেকে আর ‘রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার’ পাবে না। তিনি এ তালিকায় কোনো ঋণ খেলাপীকে দেখতে চান না, তা তিনি যত প্রভাবশালীই হোন না কেন।

শেয়ারনিউজ, ০৭ নভেম্বর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে