ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

ডলার সংকটে রপ্তানি আয়ের ভালো খবরও ম্লান

২০২৩ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৫:৪৬:০৮
ডলার সংকটে রপ্তানি আয়ের ভালো খবরও ম্লান

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের অধিকাংশ অর্থনৈতিক সূচক নিম্নমুখী। ভালো সূচকের মধ্যে রপ্তানি আয় এবং রেমিটেন্স ছিল। ডলার সংকটের মধ্যে গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহও কমছে। সদ্য শেষ হওয়া আগস্ট মাসে দেশে প্রবাসীদের আয় ২১ শতাংশ কম। এতে ক্রমহ্রাসমান মজুদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

এছাড়া রপ্তানি আয়ের কোনো ভালো খবর নেই। এখাতে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। গত আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় ৩.৮০ শতাংশ বাড়লেও সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা পূরণ হয়নি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যবসা বাণিজ্য সংকটে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারকরা।

অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, ডলার সংকট ও দর বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বড় ধরনের সংকটের দিকে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর আমদানি নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদা মতো পণ্য ও কাঁচামাল আনতে পারছেন না। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে।

এরফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৬৯ শতাংশে। পণ্যের বাড়তি দাম মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপন্ন করে তুলছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্টে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৪৭৮ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ১৭ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার ডলার বেশি। শতাংশের হিসেবে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩.৮০ শতাংশ।

তবে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা পূরণ হয়নি। ওই মাসে সরকারের রপ্তানি বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮৭ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। ইপিবি’র তথ্যমতে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আগস্ট মাসে তৈরি পোশাক, ওষুধ এবং চামড়াসহ ২৬ ধরনের পণ্য বিশ্ববাজারে রপ্তানি হয়েছে। সেখান থেকে আগস্টে ৪৭৮ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছিল ৪৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

সে হিসেবে গত বছরের তুলনায় ১৭ কোটি ৫১ লাখ ইউএস ডলার পরিমাণ আয় বেড়েছে, যা শতাংশের হিসাবে বেড়েছে ৩.৮০ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় এই বছরের আগস্ট মাসে রপ্তানি আয় বাড়লেও সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল সেটি পূরণ হয়নি। বিদায়ী মাসে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮৭ কোটি ২১ লাখ ৯০ হাজার ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় কম হয়েছে, যা শতাংশের হিসাবে ১.৮১ শতাংশ।

এই বিষয়ে বিজিএমইএ’র পরিচালক ও মুখপাত্র মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, রপ্তানিকারকরা বলে আসছিলেন যে, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব এবং আমদানিকারক দেশগুলোর মূল্যস্ফীতির চাপের প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে। কারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে ক্রেতাদের আমদানি কমে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাক খাতের রপ্তানি কমবে। তার কিছুটা চিত্র দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ের রপ্তানি আয়ের হিসাবে।

রপ্তানিখাত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক বছর বিশ্ববাজারে ঋণের সুদহার অনেক কমেছিল। ওই সময়ে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ অনেক বাড়িয়েছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে প্রতিবছরই রপ্তানি ও রেমিট্যান্সেও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

রিজার্ভ বাড়তে থাকায় তখন এতটাই আত্মতুষ্টি দেখা দেয়, রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হয়। এমনকি রিজার্ভ থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঋণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। ২০২১ সালের শেষদিকে অর্থনীতিতে করোনা-পরবর্তী বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। তখন আমদানির চাহিদা বাড়ে।

অন্যদিকে, রেমিট্যান্স কমে যায়। এর প্রভাবে কমতে থাকে রিজার্ভ। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করে। সংকট কাটাতে এখন কঠিন শর্তে আইএমএফ’র ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে।

রেমিট্যান্স কমছে: এ বছরের প্রথম ৬ মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড ১১ লাখ ৩৬ হাজার। শ্রমিক যাওয়া এভাবে বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। আগস্টে রেমিট্যান্স ২১.৪৮ শতাংশ কমে ১৬০ কোটি ডলারে নেমেছে।

আর অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৫৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৫৬ কোটি ডলার বা ১৩.৫৬ শতাংশ কম। অথচ করোনার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল রেকর্ড ২৪.৭৮ বিলিয়ন ডলার।

আমদানি কমায় রপ্তানিতে প্রভাব: ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। ডলারের সংকট থাকা এবং একই সময়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপের কারণে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) আমদানি ব্যয় ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারে নেমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে মূলধনি পণ্যের আমদানি ১৭.৪০ শতাংশ কমেছে। তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২.২০ শতাংশ। মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আমদানি কম হয় ১৩শ’ কোটি ডলার। অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় হয় ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলার।

পরের অর্থবছর অর্থাৎ গত অর্থবছরে রপ্তানি আয় ৩০৯ কোটি ডলার বেড়ে ৫ হাজার ২৩৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। আমদানি ব্যয়ে বড় সাশ্রয় এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ার পরও ডলার সংকট থেকে বের হওয়া যায়নি। তবে আমদানি কমায় প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে করে শিল্প-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে। ডলার বাজারে অস্থিরতার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে পোশাক খাত শঙ্কায় আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের অর্ডার কমছে। এ ছাড়া পোশাক শিল্পঘন এলাকায় বিদ্যুৎ, গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের অর্ডার কমছে। তবে আমরা এখন নতুন বাজারে যাচ্ছি।

উদ্যোক্তারা বলেন, পণ্য তৈরি করতে অধিকাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। গত বছর যখন বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটে এবং একইসঙ্গে টাকার বিনিময় হার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়, তখন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলার খরচও বেড়ে যায়, যা পণ্য তৈরির খরচ বাড়িয়ে দেয়।

শেয়ারনিউজ, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩

পাঠকের মতামত:

অর্থনীতি এর সর্বশেষ খবর

অর্থনীতি - এর সব খবর



রে