ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

জেমিনি শেয়ার নিয়ে মাফিয়া চক্রের নতুন ফাঁদ

২০২৩ জুন ২৩ ২১:৩০:০৩
জেমিনি শেয়ার নিয়ে মাফিয়া চক্রের নতুন ফাঁদ

শাহ মোঃ সাইফুল ইসলাম: শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেমিনি সী ফুড লিমিটেড কোম্পানিটির মুনাফা ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে দেখিয়েছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। ডিএসইর তদন্তের প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির সঠিক মুনাফা নির্ধারণ করতে এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিএসইসির তদন্ত কমিটি গঠনের প্রেক্ষিতে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে যে মাফিয়া চক্রটি কারসাজিতে জড়িত ছিল সেই দুই সংসদ সদস্য এবাদুল করিম বুলবুল ও কাজী নাবিল আহমেদদের মাথায় ভাজ পড়েছে। কারণ কোম্পানিটির তিন প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফার যে ঝলক দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে নানা রকম পরিকল্পনা সাজিয়েছিল চক্রটি। কিন্তু আর্থিক প্রতিবেদন ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে দেখানোর রহস্য প্রকাশ হয়ে পড়ায় তাদের সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে বসেছে। এখন নতুন পরিকল্পনায় কারসাজি চক্রটি যোগ করছে গুজব ও ভুয়া প্রচারণা।

কোম্পানিটির মুনাফা ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে দেখানোর পর কারসাজি চক্রটি প্রচার করেছিল ৩০ জুন ২০২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফা ২৫ টাকার ওপরে আসবে। এর প্রেক্ষিতে কোম্পানিটি এবছর বড় ডিভিডেন্ড ঘোষণা করবে। তারমধ্যে থাকবে বড় আকারে বোনাস ডিভিডেন্ড। এরপর মূলধন বাড়ানোর জন্য কোম্পানিটি রাইট শেয়ারও ইস্যু করবে। যার কারণে কোম্পানিটির শেয়ার দাম ১৫০০ টাকা ছুঁয়ে লেনদেন হবে।

কিন্তু বিএসইসির তদন্ত কমিটি গঠনের পর তাদের সব রুপকল্প ভেস্তে গেছে। এখন প্রচারণায় তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এই মুহূর্তে দুই বিষয়ে প্রচারণা জোরদার করছে চক্রটি।

প্রথমটি হলো-বিএসইসির তদন্ত কমিটিতে কিছু যায়-আসে না। কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণার প্রস্ততি নিচ্ছে। আগামী মাসেই ডিভিডেন্ড ঘোষণা করবে।

দ্বিতীয়টি হলো-কোম্পানিটি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা প্রকল্প ঋণ পাচ্ছে। ঋণ পাওয়ার পর শেয়ারটির দর অনেক ওপরে চলে যাবে। সুতরাং শেয়ারটি কেনার এখনই মোক্ষম সময়।

শেয়ারনিউজের পক্ষ থেকে কারসাজি চক্রের ওই দুই প্রচারণার সত্যতা যাচাইয়ে বিএসইসি ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিএসইসি ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বক্তব্য ও মতামত বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তুলে ধরা হলো-

বিএসইসি যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, সেই কমিটিকে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে। অর্থাৎ তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন দিতে প্রায় ৩ মাস সময় পাবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের পর বিএসইসি ওই প্রতিবেদনের উপর সিদ্ধান্ত জানাবে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে কোম্পানি আলোচ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন নীরিক্ষিত আকারে তৈরি করবে। এরপর ডিভিডেন্ড ঘোষণার উদ্যোগ নেবে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৪-৫ মাস সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরের আগে কোম্পানিটি এবছর ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারছে না।

তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেওয়ার আগে কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদন চুড়ান্ত করে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে কি না-এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএসইসির তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা শেয়ারনিউজকে বলেন, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে মুলত কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুযারি-মার্চ’২৩) আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখার জন্য। কমিটিকে তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন দেখতে হলে আগের দুই প্রান্তিকের প্রতিবেদনও দেখতে হবে। যার ভিত্তিতে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করবে। সুতরাং ওই তিন প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন চুড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিভাবে কোম্পানি পুরো বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চুড়ান্ত করবে। আর আর্থিক প্রতিবেদন চুড়ান্ত করার আগে বছরশেষে যে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করা হয়, সেই ডিভিডেন্ড কোম্পানিটির ঘোষণা করার সুযোগ নেই।

এদিকে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণের বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া বলে জানা গেছে। ব্যাংক বলছে, জেমিনি সী ফুড শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকই নয়। গ্রাহক না হলে কোনো কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া যায় না।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জনসংযোগ প্রধান শামসুদ্দোহা শেয়ারনিউজ প্রতিবেদককে বলেন, কোম্পানিটি শাহজালাল ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে, এমন বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। শেয়ারনিউজের প্রতিবেদকের সামনে তিনি ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে ইন্টারকমে কথা বলেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, তিনি জেমিনি সী ফুডের ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না।

শামসুদ্দোহা বলেন, বিএসইসি যেহেতু কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, এমতাবস্থায় কোম্পানিটি ঋণের আবেদন করলেও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তারপরও জেমিনির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করা মাফিয়া চক্রটি বসে নেই। তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মাঝে গুজব ছড়িয়েই চলেছে। কয়েকটি বড় ব্রোকারেজ হাউজে গিয়ে শেয়ারটি ‘ফিডিং’করার প্রয়াস চালাচ্ছে মাফিয়া চক্রটির লোকজন। এমন তথ্য ব্রোকারেজ হাউজগুলো জানিয়েছে শেয়ারনিউজের প্রতিবেদককে। গত ৩-৪ দিন শেয়ারবাজার ঘুরে জানা গেছে, তদন্ত কমিটি গঠনের পর থেকে শেয়ারটির প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেছে। এখন কারসাজি চক্র নিজেরা নিজেরাই শেয়ারটি নিয়ে চালাচালি করছে। যে কারণে শেয়ারটির দাম ও লেনদেনে গতি অব্যাহত রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের পাতানো ফাঁদেই এখন কারসাজি চক্রটি আটকে গেছে। তাঁরা বিনিয়োগকারীদের শেয়ারটিতে ভেবে-চিন্তে বিনিয়োগ করার পরামর্শ দেন।

নন-মার্জিন হয়ে গেছে জেমিনি সী ফুড

বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ি, পিই রেশিও ৪০-এর নিচে থাকা শেয়ারে মার্জিন ঋণ দেওয়া হয়। সেই হিসাবে তদন্ত কমিটি গঠনের আগেও জেমিনির শেয়ার মার্জিনেবল ছিল। কিন্তু বিএসইসসির তদন্ত কমিটি গঠনের পর ব্রোকারেজ হাউজগুলো জেমিনির শেয়ারে মার্জিন বন্ধ করে দিয়েছে। লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজ ও লঙ্কাবাংলা ফিন্যান্স তাদের মার্জিন তালিকায় জেমিনি শেয়ারে মার্জিন দেওয়ার বিষয়ে বলেছে, ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তে মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক সিকিউরিটিজসহ বড় বড় ব্রোকারেজ হাউজগুলো জেমিনির শেয়ারে মার্জিন ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলো বলছে, যেহেতু শেয়ারটির আর্থিক প্রতিবেদন ক্রটিযুক্ত, সেহেতু শেয়ারটিতে মার্জিন ঋণ এখন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রসঙ্গত, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ’২৩) জেমিনি সী ফুড শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছে ৮ টাকা ২০ পয়সা। যা আগের বছর একই সময়ে ছিল মাত্র ০৪ পয়সা। অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে (জুলাই’২২-মার্চ’২৩) কোম্পানিটির ইপিএস হয়েছে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা। যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৫ টাকা ১৬ পয়সা।

ডিএসইর তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে. কোম্পানিটি আলোচ্য সময়ে যে মুনাফা দেখিয়েছে, সেই মুনাফার প্রায় অর্ধেকের কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে পারেনি কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আলোচ্য অর্থবছরের তিন প্রান্তিকে (জুলাই ‘২২-মার্চ’২৩) কোম্পানিটির আয় দাঁড়িয়েছে ৬৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ২৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা স্থানীয় বিক্রয় থেকে এসেছে। বাকি ৩৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা রপ্তানি আয় থেকে এসেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে ১৬টি লেনদেনের মাধ্যমে সাতটি কোম্পানির কাছে বিক্রির কোনো প্রমাণ পায়নি ডিএসইর তদন্ত কমিটি।

এই বিষয়ে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট অফিসার শফিক আহমেদ শেয়ারনিউজকে বলেন, (জুলাই’২২-মার্চ’২৩) সময়ের মধ্যে এটি স্থানীয় বিক্রির মাধ্যমে আয় করেছে। কারণ রপ্তানির পর দুটি পাত্রে সামুদ্রিক খাবার ফিরে আসে এবং কোম্পানি স্থানীয়ভাবে সেই পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কোম্পানিটি সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের সুবিধার জন্য এবং আয় বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয়ভাবে পণ্য বিক্রয় করেছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলছে, বিএসইসির তদন্ত কমিটি কোম্পানিটির সম্পদ, দায় এবং ইক্যুইটি সম্পর্কে সত্য এবং ন্যায্য ব্যালেন্স শীট এবং আর্থিক বিবৃতির অন্যান্য অংশ পর্যালোচনা করবে। এটি গত পাঁচ বছরে কোম্পানি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পক্ষের লেনদেন পর্যালোচনা করবে।

শেয়ারনিউজ,২৯ আগস্ট ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে