ঢাকা, মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
Sharenews24

রিটার্ন নেই, নজরদারিও নেই—মিউচুয়াল ফান্ডে সংকটের গভীর স্রোত

২০২৫ ডিসেম্বর ০২ ২৩:০২:৩৫
রিটার্ন নেই, নজরদারিও নেই—মিউচুয়াল ফান্ডে সংকটের গভীর স্রোত

নিজস্ব প্রতিবেদক: শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ড খাত বর্তমানে একটি কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী সংকটে নিমজ্জিত। বছরের পর বছর ধরে ইউনিট হোল্ডাররা কোনো প্রত্যাশিত রিটার্ন পাচ্ছেন না। এই পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস নষ্ট করেছে এবং অব্যবস্থাপনা, তহবিল পাচার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল তদারকিকে প্রকাশ্যে এনেছে।

যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাজারে মিউচুয়াল ফান্ড দীর্ঘমেয়াদী পারিবারিক সঞ্চয়কে সমর্থন করে, সেখানে বাংলাদেশের ইউনিট হোল্ডাররা ক্রমাগত লোকসান এবং অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হচ্ছেন। এতে নিকট ভবিষ্যতে এই খাতের পুনরুদ্ধার নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল রিটার্ন, নীতিগত ভুল, অনিয়ম এবং জবাবদিহিতার অভাব মিউচুয়াল ফান্ড খাতকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ বাহন হিসেবে তার ভূমিকা প্রমাণ করতে ব্যর্থ করেছে।

মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে শেয়াবাজার সংশ্লিষ্টদের অভিমত হলো, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা আর রিটার্ন আশা করছেন না বলেই এই খাতটি বাড়ার পরিবর্তে ডুবছে। তারা অভিযোগ করেন, অ্যাসেট ম্যানেজাররা (সম্পদ ব্যবস্থাপক) তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় নিয়ম লঙ্ঘন করে চলেছেন। কেউ কেউ তহবিল সরিয়ে নিতে অ-লাভজনক অ-তালিকাভুক্ত ফার্মে বিনিয়োগ করছেন, যার ফলে ইউনিট হোল্ডারদের লোকসান হচ্ছে। তার মতে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা যথেষ্ট কঠোরভাবে তদারকি কার্যকর না করায় এই ধরনের অনিয়ম শিকড় গেড়েছে।

বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে 'ক্লোজড-এন্ড ফান্ড'-এর অংশ ৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা এবং 'ওপেন-এন্ড ফান্ড'-এর অংশ ৫ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৭টি ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের মধ্যে ৩৫টিই তাদের নিট সম্পদ মূল্যের (এনএভি) চেয়ে কম দামে লেনদেন হচ্ছে এবং ৩৩টি তাদের ফেস ভ্যালু বা অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের মূল্য ৩০ শতাংশ থেকে ১৫০ শতাংশ কমেছে। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্লোজড-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর বাজার মূলধন ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। বেশিরভাগ ফান্ডই বছরের পর বছর ধরে প্রত্যাশিত হারে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারেনি।

যেসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা পেশাগতভাবে পরিচালিত স্থিতিশীল রিটার্নের আশা করেছিলেন, তারা এখন এনএভি হ্রাস, দুর্বল ডিভিডেন্ড রেকর্ড এবং অনিয়মের অভিযোগ দেখছেন। ইউনিট হোল্ডাররা লোকসান বহন করা সত্ত্বেও অ্যাসেট ম্যানেজাররা ফি সংগ্রহ করে চলেছেন। বাংলাদেশের 'সম্পদ-ব্যবস্থাপনা থেকে জিডিপি অনুপাত মাত্র ০.১৭ শতাংশ, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। যেখানে ভারতে এই অনুপাত ১৬.২ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬.৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১.৭ শতাংশ।

ইনভেস্টর অনুপ্রবেশের হার মাত্র ১ শতাংশ। মালয়েশিয়ায় এই হার ৯ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৬.৬ শতাংশ এবং ভারতে ২.১ শতাংশ (গ্রিন ডেল্টা ড্রাগন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের তথ্যমতে)। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিশাল ব্যবধান দেখায় যে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর আস্থা কতটা কম এবং পারিবারিক সঞ্চয়ে এই খাতের অবদান কতটা সীমিত।

বিএসইসি'র সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা মূলত স্বল্পমেয়াদী ব্যবসায়ী এবং বছরের পর বছর ধরে রিটার্ন কম থাকায় তারা মিউচুয়াল ফান্ডে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিনি অ্যাসেট ম্যানেজারদের পেশাদারিত্বের অভাবের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, দীর্ঘস্থায়ী বাজার অস্থিরতাও ইউনিট হোল্ডারদের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ রিটার্ন দিতে বাধা দিচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ, মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পে অনিয়মের পাহাড় জমেছে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দাবি করছেন, এই খাতটি প্রায় ২৫ বছর পিছিয়ে গেছে এবং অতীতের অনিয়মগুলোর সমাধান না করলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন না। তারা জানান, বর্তমান কমিশন তদন্তের পর কিছু অপারেটরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছে, তবে ফলাফলগুলো জনসমক্ষে আনা উচিত। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলেন, সীমিত আর্থিক সাক্ষরতা, কঠোর বিনিয়োগের নিয়ম, মানসম্পন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানির অভাব এবং দুর্বল প্রচারণার মতো কাঠামোগত দুর্বলতা এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

২০১৮ সালে ক্লোজড-এন্ড ফান্ডগুলোর ১০ বছরের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা বদলে দেয় এবং তাদের আস্থা ক্ষুণ্ন করে। অব্যবস্থাপনা আরেকটি প্রধান কারণ। বেশ কিছু অ্যাসেট ম্যানেজার অতিরিক্ত দামে অ-তালিকাভুক্ত বা দুর্বল ফার্মে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে আরএসিই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (যা ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের ৪৮.০২ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে) মাল্টি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড সার্ভিসেস, পদ্মা ব্যাংক এবং রিজেন্ট স্পিনিং মিলসের বন্ডে বিনিয়োগ করে। এলআর গ্লোবাল (যা ১৬.২১ শতাংশ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে) এনার্জিপ্যাক প্রিমা, ইউনিকর্ন ইন্ডাস্ট্রিজ এবং পদ্মা প্রিন্টার্সের (বর্তমানে কোয়েস্ট বিডিসি) শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এই বিনিয়োগগুলো ইউনিট হোল্ডারদের জন্য কোনো কার্যকর রিটার্ন দিতে পারেনি, কিন্তু তদারকির দায়িত্বে থাকা ট্রাস্টিরা কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।

এছাড়াও ইউএফএস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট এবং অ্যালায়েন্স ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে তহবিল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেই পাচার হওয়া তহবিল পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। বাংলাদেশে একটি ছোট বাজারের জন্য ৫৮টি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে, যেখানে ভারতের বিশাল বাজারে মাত্র ৪৪টি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি রয়েছে। এই অতিরিক্ত ভিড় অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে এবং অনিয়মের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

বাজারের ক্রমাগত চাপ পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করেছে। দীর্ঘমেয়াদী বাজার মন্দার কারণে সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে ঢাকা শেয়ারবাজারের প্রধান সূচক ৮৬৩ পয়েন্ট কমে গেছে। মিউচুয়াল ফান্ডগুলো উল্লেখযোগ্য অ-স্বীকৃত লোকসান দেখায় এবং ডিভিডেন্ড ঘোষণার আগে পূর্ণ প্রভিশন বজায় রাখতে বাধ্য হয়, যা তাদের রিটার্ন বিতরণের ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়।

অক্টোবর মাসে বিএসইসি ছয়টি এলআর গ্লোবাল-পরিচালিত ফান্ডের লেনদেন স্থগিত করে, কারণ একটি অকার্যকর ওটিসি কোম্পানি পদ্মা প্রিন্টার্সের মাধ্যমে প্রায় ৬৯ কোটি টাকা অপব্যবহারের ঘটনা সনাক্ত করা হয়েছিল। বিএসইসি ১৩ নভেম্বর নতুন 'মিউচুয়াল ফান্ড রেগুলেশনস, ২০২৫' চালু করেছে। এই বিধিমালায় নতুন ক্লোজড-এন্ড ফান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিদ্যমান ফান্ডগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধি বন্ধ করা হয়েছে এবং যে ফান্ডগুলো প্রয়োজনীয় বাজার মূল্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে, সেগুলোকে ওপেন-এন্ড ফান্ডে রূপান্তর বা অবসায়নের মুখোমুখি হতে হবে।

১৮৮০ সালে আইসিবি'র প্রথম আইসিবি ফান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পের শুরু হয়েছিল। তবে বছরের পর বছর ধরে আস্থা ও স্বচ্ছতার অভাবে এই খাতের পুনরুদ্ধার এখন এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অপেক্ষায়।

সালাউদ্দিন/

শেয়ারনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে থাকতে SUBSCRIBE করুন

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে