ঢাকা, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪
Sharenews24

কারসাজির সুযোগ দিতেই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না তিন কোম্পানি

২০২৩ আগস্ট ২৭ ২১:০৯:৪০
কারসাজির সুযোগ দিতেই আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না তিন কোম্পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ কারসাজির জন্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। যার ফলে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছেন।

অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের অন্ধকারে রেখে কারসাজি চক্র কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে সমানতালে কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে। এতে লাভবান হচ্ছে কোম্পানিগুলোর কিছু লোকজন এবং কারসাজিকারীরা। বিপরীতে বার বার ক্ষতির মুখে পড়ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কোম্পানি ৩টি হলো-সোনালী পেপার, মিরাকল ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং ইমাম বাটন।

অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলোর শেয়ার কারসাজির জন্য সামান্য ইতিবাচক খবরও আকাশছোঁয়া করে প্রকাশ করার প্রাণপন চেষ্টা চালায় কোম্পানিগুলোর পরিচালনা পর্ষদ। অপরদিকে, কোম্পানিগুলোর মুনাফার চিত্র ধারাবাহিকভাবে খারাপের দিকে থাকলেও তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। কোম্পানিগুলোর পর্ষদের এই দূরভিসন্ধি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও জানে। তারপরও নিরব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলোর কারসাজিকারীদের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের সুসম্পর্ক রয়েছে। যার কারণে কোম্পানিগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজিকারীরা সিরিয়াল কারসাজি করতে পারছে।

সোনালী পেপার

শেয়ারবাজারে বহুল আলোচিত-সমালোচিত কোম্পানি সোনালী পেপার। সরকারের বিসিএস এক ক্যাডার কর্মকর্তা শেয়ারটি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত কারসাজিতে সম্পৃক্ত রয়েছেন। যিনি ১৯৭ টাকার শেয়ারটিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে হাজার টাকার কাছাকাছি তুলেছিলেন। তারপর কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজস করে ১টি শেয়ারের বিপরীতে ২টি রাইট শেয়ার ইস্যুরও ব্যবস্থা করেছিলেন। রাইট শেয়ার ইস্যুর পর শেয়ারটির দাম সাড়ে ৩০০ টাকার নিচে লেনদেন হয়। তারপর আবারও মুনাফা ঝলক দেখিয়ে শেয়ারটি ৬০০ টাকার ওপরে তোলা হয়। এখন ফের শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি শুরু করেছেন আলোচিত ওই ক্যাডার কর্মকর্তা। বছরজুড়েই থেমে থেমে শেয়ারটি নিয়ে তিনি কারসাজিতে মেতে রয়েছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নাকি তার গভীর সখ্যতা। যে কারণে তিনি নিরাপদেই শেয়ারটি নিয়ে সিরিয়াল কারসাজি করছেন। তার বিরুদ্ধে আরও অনেক শেয়ার কারসাজির অভিযোগ রয়েছে। তাকে এখন অনেকে ‘শেয়ারবাজারের কিং’ বলে অভিহিত করছেন।

রাইট শেয়ার ইস্যু করার পর শেয়ারদর ফের আকাশচুম্বী করার লক্ষ্যে সোনালী পেপার ৩০ জুন, ২০২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ঝলক দেখানো মুনাফা দেখায়। যার সুবাদে শেয়ারটি সাড়ে ৩০০ টাকার নিচে এসে ফের ওপরের দিকে টার্ন নেয়। তারপর শেয়ারটির দর কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম প্রান্তিকে ঝলক দেখানো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোম্পানিটি পরবর্তীতে দ্বিতীয় প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর’২২) এবং তৃতীয় প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ’২৩) প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

শেয়ারবাজারে অনেকদিন যাবত গুঞ্জন রয়েছে, কোম্পানিটির উৎপাদন থেমে থেমে চলছে। যে কারণে কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার জন্য গত শনিবার শেয়ারনিউজের প্রতিনিধি সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শন করেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কোম্পানিটির ২টি উৎপাদন ইউনিটের মধ্যে ১টির উৎপাদন চলছে। অন্যটির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। তবে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলেছেন, রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই ইউনিটটির উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রয়েছে। রোববারই চালু করা হবে।

সোনালী পেপার সমাপ্ত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’২২) শেয়ারপ্রতি মুনাফা দেখিয়েছে ৭ টাকা ২ পয়সা। রাইট শেয়ার ইস্যু করার পরও মুনাফায় বড় ঝলক। যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ৩ টাকা ৭০ পয়সা। এরপর কোম্পানিটি পরবর্তী দুই প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, পরের দুই প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। যে কারণে দ্বিতীয় (অক্টোবর-ডিসেম্বর’২২) ও তৃতীয় (জানুয়ারি-মার্চ’২৩) প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত রয়েছে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ।

মিরাকল ইন্ডাষ্ট্রিজ

শেয়ারদর বাড়ানোর জন্য মিরাকল ইন্ডাষ্ট্রিজের নতুন পরিচালনা পর্ষদ মালিকানা পরিবর্তন ও উৎপাদন শুরু করার খবর ফলাও করে প্রচার করেছে। কিন্তু কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে যাওয়ায় তা প্রকাশ করেনি। কারণ লোকসানের পাল্লা ভারির খবর প্রচার হলে শেয়ার দরে কারসাজি করা দুরুহ হয়ে পড়বে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটির নতুন পরিচালনা পর্ষদ অবশ্যই কোম্পানির সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা হিসাব করে বুঝে নিয়েছেন। আর্থিক অবস্থার হিসাব ছাড়া কোনোভাবেই কোম্পানিটি হস্তান্তর হয়নি। তাহলে কেন আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো না। আর্থিক প্রতিবেদন ভালো নয় বলেই কারসাজির স্বার্থে তা প্রকাশ করা হয়নি, এমনটাই অভিযোগ করছেন তাঁরা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালে মিরাকল ইন্ডাষ্ট্রিজ বিনিয়োগকারীদের ১ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। সেই বছর কোম্পানিটির লোকসান ছিল শেয়ারপ্রতি ৩ টাকা ৬২ পয়সা। তারপর থেকে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ এবং বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রতিবেদন থেকে অন্ধকারে রেখেছে। এক শতাংশ ডিভিডেন্ড দিয়ে শেয়ারটি কারসাজিকারিদের তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল।

গত সপ্তাহে কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন ও উৎপাদনে ফেরার খবর স্টক এক্সচেঞ্জে এসেছে। কিন্তু তার আগে থেকেই কোম্পানিটির লোকজনের সঙ্গে একটি দুষ্টু চক্র শেয়ারটি নিয়ে কারসাজি শুরু করছে। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, কারসাজির উদ্দেশ্যে কোম্পানিটির মালিকানা পরিবর্তন ও উৎপাদনের ফেরার খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে; কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রতিবেদন জানানো হয়নি। যদিও মালিকানা পরিবর্তনের সঙ্গে কোম্পানির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।

উল্লেখ্য, কোম্পানিটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বা বিদেশি কোনো বিনিয়োগ নেই। উদ্যোক্তা পরিচালকদের রয়েছে ৩০ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদর কাছে রয়েছে বাকি ৭০ শতাংশ।

ইমাম বাটন

দীর্ঘ ৩ বছর ধরে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ইমাম বাটনের। কোম্পানিটি উৎপাদনে ফেরার বিষয়ে কোনো আপডেট তথ্য নেই। অথচ তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করার জন্য কোম্পানিটি সম্প্রতি জানিয়েছে, বরগুনার আমতলীতে ১ কোটি টাকায় একটি এগ্রো প্রকল্প লিজ নিয়েছে। খবরটি একেবারেই নস্যি। তারপরও তা ফলাও করে প্রচার করার প্রাণপন চেষ্টা করেছে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ।

কোম্পানিটি বন্ধ থাকলেও এর শেয়ার নিয়ে বছরজুড়ে চলছে কারসাজি। গত ২০২২ সালের জুলাই মাসে কোম্পানিটির শেয়ার কারসাজি খতিয়ে দেখতে বিএসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি।

কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১০ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ বোনাস ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। তারপর থেকেই ধারাবাহিক লোকসানে থাকে কোম্পানিটি। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি সর্বশেষ বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রতিবেদন জানিয়েছে। সে বছর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ৪০ পয়সা এবং রিজার্ভ ছিল নেগেটিভ ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। তারপর থেকে কোম্পানিটি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত রয়েছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসান আগের চেয়ে অনেক বেশি। যা প্রকাশ করলে শেয়ারটি কারসাজি করা দুস্কর হবে। কারসাজিকারীদের সুবিধা দিতেই কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকছেন।

শেয়ারনিউজ, ২৭ আগস্ট ২০২৩

পাঠকের মতামত:

শেয়ারবাজার এর সর্বশেষ খবর

শেয়ারবাজার - এর সব খবর



রে